সৌদিতে হাজিদের সেবায় বাংলাদেশি হাফেজের নজরকাড়া ভূমিকা
-
-
|

হাফেজ জিয়াউর রহমান, কোলাজ: বার্তা২৪.কম
সৌদি আরবে বাংলাদেশের হজ ও উমরা পালনকারীদের সেবা দিয়ে আলোচনায় উঠে এসেছেন হাফেজ জিয়াউর রহমান। সৌদি প্রবাসী ওই হাফেজের প্রতিষ্ঠিত ‘বীনা ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সপোর্ট এন্ড ক্যাটারিং সার্ভিস কোম্পানি’র কার্যক্রম ইতোমধ্যে সৌদি সরকারেরও নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে। এর ফলে বিভিন্ন নামিদামি সৌদি কোম্পানি তাদের সঙ্গে কাজ করতে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে।
বাংলাদেশি হজ ও উমরা এজেন্সির মালিকদের মুখে মুখে তার নাম। হাজিদের ইবাদত-বন্দেগি পালনে তার সহায়ক ভূমিকা ভূঁয়সী প্রশংসা কুঁড়িয়েছে। আগামী রমজানের উমরা ও হজ মৌসুমে বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে হাজির হতে চাচ্ছেন।
বীনা ইন্টারন্যাশনালের কার্যক্রম প্রসঙ্গে হাফেজ জিয়াউর রহমান বার্তা২৪.কমকে বলেন, বীনা ইন্টারন্যাশনাল সৌদি আরবে হাজিদের সেবাদানকারী কোম্পানি আল দিয়াফা গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান। এটি বাংলাদেশ থেকে আসা হজ এবং উমরা হাজিদের সেবা দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ২০২৪ সালের হজে বাংলাদেশের ৯০টি হজ এজেন্সির ২৮ হাজারের বেশি হাজিকে আমরা সেবা দিয়েছি। গতবছর বাংলাদেশ থেকে আসা প্রায় তিন লাখের বেশি উমরা হাজির মধ্যে আমাদের কোম্পানির মাধ্যমে ভিসা হয়েছে দেড় লক্ষাধিক।
তিনি বলেন, হজ ও উমরাযাত্রীদের উত্তম সেবা দেওয়ার জন্য প্রায় দুইশর কাছাকাছি কর্মী রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশি কর্মী শতাধিক। এছাড়া ভারত-পাকিস্তানসহ সাতটি দেশের জনবল কাজ করে আমাদের সঙ্গে। হজের সময় অতিরিক্ত প্রায় পাঁচশ বাংলাদেশি কাজ করে। এই কর্মীদের মধ্যে বাংলাদেশিদের প্রাধান্য দেওয়া হয়। ফলে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখা যায়, যাতে আমার দেশ লাভবান হয়।
সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে আপনি বাংলাদেশের উমরা যাত্রীদের নিয়ে ভাবনার কারণ কি? এমন প্রশ্নে হাফেজ জিয়াউর রহমান বলেন, ২০১৫ সালে আমাদের দেশের কিছু অসাধু-লোভী উমরা ও ট্রাভেল ব্যবসায়ীর কারণে বিভিন্ন কোম্পানি বন্ধ হয়ে যায়। তারা উমরায় এমন লোকদের পাঠাতেন, যারা সৌদি আরব এসে আর ফেরত যেত না। এ জন্য বাংলাদেশিদের সঙ্গে সৌদির কোনো উমরা কোম্পানি কাজ করবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়।
তখন আমাদের দেশের উমরা প্রত্যাশীদের সৌদি আরব আসা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ওই সময় বাংলাদেশি ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর জন্য উমরার কাজ করা সহজ ছিলো না। তখন আমি উদ্যোগ নিয়ে সৌদির বীনা কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশের হয়ে বীনা ইন্টারন্যাশনাল নাম দিয়ে চুক্তি করি। তখন বাংলাদেশের প্রায় ৩০ থেকে ৪০টি ট্রাভেল এজেন্সি আমাদের সঙ্গে উমরার কাজ করার চুক্তি করে। আবার বাংলাদেশের উমরা কার্যক্রম শুরু হয়।
কবে থেকে হজ কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হলেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, আমি ১৯৯৭ সাল থেকে হজের কাজ শুরু করি। করোনা পরবর্তী সময়ে ২০২৩ সালে ভাবলাম, হজের সময় যেসব হাজি বাংলাদেশ থেকে আসেন তারা হজের মূল অংশে সৌদি মক্তবের (সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান) অধীনে থাকায় ভাষা না জানা এবং খাবারের ভিন্নতায় তাদের অনেক কষ্ট হয়। এ জন্য ২০২৩ সালে এর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হই।
২০২৩ সালে আমরা প্রায় সাড়ে ছয় হাজার হাজির সেবা দিয়েছি। ২৪ সালে সেটা বেড়ে ২৮ হাজার হয়ে যায়। কাজ শুরু করেই আমরা বড় একটি সফলতা অর্জনে সক্ষম হই। সেই প্রেরণা ও অভিজ্ঞতা থেকে ২০২৪ সালের হজ নিয়ে একটি মাইলফলক ঠিক করি এবং প্রস্তুতি নেই। কিন্তু সৌদি সরকার এ বছর এসে কিছু নতুন নিয়মকানুন তৈরি করে। যার মধ্যে রয়েছে- নুসুক সিস্টেমের কার্ড, মিনার জোন এবং তাঁবু নির্ধারণ, পরিবহন-ট্রাফিক সিস্টেমসহ সব কার্যক্রমে নতুন নিয়ম-পদ্ধতি চালু করা হয়, যা আগের সব নিয়মের পুরোপুরি উল্টো। এতে আমাদের প্রস্তুতি কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বিরাট বিড়ম্বনায় পড়ে যাই। তাত্ক্ষণিকভাবে এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এজেন্সির মালিক, গ্রুপলিডার এবং আমাদের বীনার কর্মীরা ঝাপিয়ে পড়ে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্ঠায় হাজিদের সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করেছি আমরা।
হাজিদের পরিবহন সেবার ক্ষেত্রে হাফেজ জিয়াউর রহমানের ব্যাপক সুনাম রয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সৌদি আরবে আমিই একমাত্র বাংলাদেশি; যার হজ-উমরা মন্ত্রণালয় এবং ট্রান্সপোর্ট মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমোদিত নিজস্ব লাইসেন্স করা ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি রয়েছে। বাংলাদেশি হজ-উমরা যাত্রীদের ভালো সার্ভিস দিতে হলে নিজস্ব যানবাহন ছাড়া সেটা সম্ভব নয়। নিজস্ব যানবাহন থাকলে সর্বোচ্চ ভালো সার্ভিস দেওয়া সম্ভব। সেই চিন্তা থেকেই পরিবহন সার্ভিস নিয়ে আসা।
বাংলাদেশি হাজিদের খাবার সরবরাহের ভাবনা প্রসঙ্গে বলেন, আসলে হজের সময় সৌদি মোয়াল্লিমের পক্ষ থেকে হাজিদের যে খাবার সরবরাহ করা হয়- সেটা আমাদের দেশের মানুষের জন্য মুখরোচক নয়। অধিকাংশ হাজি সেটা খেতে পারেন না। প্রচুর খাবার নষ্ট হয়। আর হাজিরাও ক্ষুধায় কষ্ট করেন। আমি চেষ্ট করলাম হাজিদের বাংলাদেশী মুখরোচক খাবারের আয়োজন করতে। যে খাবার হাজিরা খেতে অভ্যস্ত। আলহামদুলিল্লাহ! সৌদি সরকার অনুমোদিত প্রায় চল্লিশ হাজার হাজির খাবার পরিবেশনের জন্য সরকার অনুমোদিত বীনা ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানির নিজস্ব ৪টি কিচেন পরিচালনা করছে।
হজ ও উমরা নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে হাফেজ জিয়াউর রহমান বলেন, হাজিদের সেবার জন্য যে গাড়িগুলো রয়েছে; সেগুলো সামর্থ্যের আলোকে বাড়ানো। যাতে হাজিদের চলাচলে সুবিধা হয়। পাশাপাশি আমাদের ক্যাটারিং সার্ভিসের মান আরও উন্নত করা। মক্কা-মদিনায় আবাসন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এজেন্সির চাহিদা অনুযায়ী পরামর্শের মাধ্যমে সৌদি সরকারের সঙ্গে কাজ করা। পাশাপাশি বাংলাদেশি ট্রাভেল এজেন্সিদের এসব আবাসন ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করতে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা।
বাংলাদেশ সরকার হজের দুটো প্যাকেজ ঘোষণা করে। এর বাইরে কেউ যদি বাড়তি সুবিধা ভোগ করতে চান তাদের কোনো সুযোগ রয়েছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, বাংলাদেশের এজেন্সিগুলো ডি ক্যাটাগরির সার্ভিস গ্রহণ করেন। এ ছাড়া হজের ভিআইপি ক্যাটাগরির হাজিরাও এজেন্সিগুলোর কাছে আসে। হাজিদের কেমন সেবা দেওয়া হবে সেটা তারাই ঠিক করবে। এ জন্য এজেন্সিগুলোকে কাজ করতে হয়। এজেন্সি মালিকরা আমাদের কাছে এলে আমরা ভিআইপিদের জন্য ভিআইপি হোটেল, গাড়ি, মিনার তাঁবু এবং খাবারসহ সম্পূর্ণ সেবা দিতে চেষ্টা করি।
আগামী হজের প্রস্তুতির বিষয়ে হাফেজ জিয়াউর রহমান বলেন, আগামী হজে সেবা দেওয়ার জন্য জন্য আমরা সৌদির ফ্লাইনাস কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। কয়েকটি হজ কোম্পানির সঙ্গে মিটিং শেষে হাজিদের সর্বোচ্চ সার্ভিসের নিশ্চয়তা পেয়ে ফ্লাইনাস কোম্পানির জোন-৫ এ ২০ হাজার হাজি এবং জোন-১ এ দেড় হাজার ভিআইপি হাজির জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। ফ্লাইনাস কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার যিয়াদ সাঈদের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিক চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। আমাদের নিয়ত এবং আল্লাহর সাহায্যে আমরা সর্বোচ্চ সার্ভিস দেওয়ার অভিপ্রায় ব্যাক্ত করছি, আশা করি- হাজি সাহেবরা আমাদের সার্ভিসে সন্তুষ্ট হবেন- ইনশাআল্লাহ।
অনেক হজ ও উমরা যাত্রী সৌদি আরবে নানাবিধ বিড়ম্বনার শিকার হন। তাদের বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী- এ প্রসঙ্গে হাফেজ জিয়াউর রহমান বলেন, অনেকেই ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে ভালোভাবে চুক্তি না করার কারণে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। কারও সঙ্গে আসার আগে বিস্তারিত জেনে-বুঝে চুক্তি করলে এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা কম। অনুরোধ থাকবে, কম টাকায় কেউ যেন হজ ও উমরায় না আসেন। অল্প কিছু টাকার ব্যবধানে অনেক সমস্যা হয়।