মডেল ও অভিনয় শিল্পী সৈয়দা তানিয়া মাহবুব ওরফে তিন্নি (২৪) হত্যা মামলায় বহুল আলোচিত জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভিকে খালাসের রায় ঘোষণা করেছেন আদালত।
মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) ঢাকার ২য় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোছা. শাহীনুর আক্তার এ রায় ঘোষণা করেন।
রায় ঘোষণার আগে চার্জশীটের ৪১ সাক্ষীর মধ্যে ২৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেন আদালত।
২০০২ সালের ১০ নভেম্বর রাতে খুন হন মডেল তিন্নি। এরপর থেকেই পলাতক হন অভি। পলাতক থেকেই বিদেশ পাড়ি জমান তিনি। অভি কানাডায় অবস্থান করছেন মর্মে আদালতের নথিপত্রে উল্লেখ আছে।
সংশ্লিষ্ট আদালতের অতিরিক্ত পিপি সৈয়দ আবু জাফর রিজভী বার্তা২৪.কমকে বলেন, আদালতের এ রায়ে তিনি অসন্তুষ্ট। রায়ের কপি হাতে পেয়ে তা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যা করা উচিত তিনি করবেন।
অভির পক্ষে আইনজীবী শাহ ইলিয়াস রতন জানান, তিনি অভির পক্ষে মামলা পরিচালনা করেছেন। মামলায় অভি খালাস পেয়েছেন। এ রায়ে তিনি খুশী।
২০১১ সালের ১০ এপ্রিল তিন্নির পিতা সৈয়দ মাহবুব করিম আদালতে আংশিক জবানবন্দি দিয়েছেন। কিন্তু এরপরই ২৫ আগস্ট তারিখে মামলাটির কার্যক্রম স্থগিত করেন হাইকোর্ট।
পেছন ফিরে দেখা:
মামলার নথিপত্রে দেখা যায়, তিন্নির স্বামী পিয়ালের মাধ্যমেই তিন্নির সাথে অভির পরিচয় হয়। এরপর তিন্নি ও অভির ঘনিষ্টতা বাড়ে। স্বামী পিয়াল বিষয়টি ভালভাবে নিতে পারেনি। বিয়ে করার প্রলোভন দেখিয়ে অভির পৃষ্ঠপোষকতায় ২০০২ সালের ৬ নভেম্বর পিয়ালকে ডিভোর্স দেন তিন্নি।
অভির ইচ্ছা ছিল ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে তিন্নিকে ভোগ করে যাওয়া। বিয়ে করে তিন্নিকে স্ত্রীর মর্যাদা দেওয়ার ইচ্ছা অভির কোনদিনই ছিলনা। বিষয়টি বুঝতে পেরেই তিন্নি তাকে বিয়ে করার জন্য অভিকে চাপ দেয়। অভি বিয়ে করতে অস্বীকার করলে অভির সব গোপন খবর মিডিয়ায় ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দেন তিন্নি। এরপর ১০ নভেম্বর রাত্রে ঢাকার কেরানীগঞ্জের ১ নম্বর চীন মৈত্রী সেতুর ১১ নম্বর পিলালের পাশে তিন্নির মরদেহ পাওয়া যায়।
এ ঘটনায় কেরানীগঞ্জ থানার এএসআই সফিউদ্দিন থানায় মামলা দায়ের করেন। প্রথমে কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ মামলাটি তদন্ত শুরু করলেও পরে মামলা স্থানান্তর হয় সিআইডিতে।
এর ৬ বছর পর ২০০৮ সালের ৮ নভেম্বর একমাত্র গোলাম ফারুক অভিকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দেয় সিআইডি। মামলায় বিভিন্ন সময় তিন্নির স্বামী শাফকাত হোসেন পিয়ালসহ ৫ জনকে গ্রেফতার করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ না পাওয়ায় তাদেরকে মামলায় দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
পুলিশি তদন্তে প্রাথমিকভাবে অভি অভিযুক্ত হলেও তাকে আর ধরতে পারেনি পুলিশ।
অভির অবর্তমানেই ২০১০ সালের ১৪ জুলাই ঢাকার ৭ম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ‘তিন্নি হত্যা ও লাশ গুম সংক্রান্ত মামলা’য় জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।
তদন্তে ৭ পুলিশ কর্মকর্তা:
তিন্নিকে না পেয়ে তার চাচা সৈয়দ রেজাউল করিম কেরানীগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন। তিন্নির স্বামী এবং তার বাসার কাজের মেয়ে বিনাকে ওই সময় গ্রেফতারও করে পুলিশ।
২০০২ সালের ১১ নভেম্বর অজ্ঞাত হিসেবে তিন্নির মরদেহ উদ্ধারের পর অজ্ঞাতনামা আসামির বিরুদ্ধে মামলা করেন কেরানীগঞ্জ থানার এএসআই মো. সফিউদ্দিন।
এই মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হয় ওই থানার এসআই মো. কাইয়ুমকে। তিন্নির মরদেহের ছবি পত্রিকায় ছাপা হলে নিহতের এক আত্মীয় সুজন তিন্নির মরদেহটি শনাক্ত করেন।
চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে একই বছর ২৪ নভেম্বর তদন্তভার ন্যাস্ত হয় সিআইডিতে। তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডির পরিদর্শক ফজলুর রহমানকে।
এরপর ৬ বছরে একে একে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডির পরিদর্শক সুজাউল হক, এএসপি গোলাম মোস্তফা, এএসপি আরমান আলী, এএসপি কমল কৃষ্ণ ভরদ্বাজ এবং এএসপি মোজাম্মেল হক। সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা মোজাম্মেল হকই আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন।
অভিযোগপত্রে ৪১ জনকে সাক্ষী করা হয়, জব্দ করা হয় ২২টি আলামত।
লেখাপড়ায় অসম্ভব মেধাবী ছিলেন গোলাম ফারুক অভি। এসএসসি এবং এইচএসসিতে বোর্ড পর্যায়ে মেধার স্বাক্ষর রাখেন তিনি। মেধাবী অভি অনেকটা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দিনে দিনে ধাবিত হন পতনের পথে। মূলত এরশাদের শাসনামলেই অভির উত্থান ঘটে।
নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী নিয়ে পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন তিনি। পেশীশক্তির মাধ্যমে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে করে তুলেছিলেন তার সন্ত্রাসের তল্লাট। একসময়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের হাত ধরে বরিশাল এক আসন থেকে নির্বাচিত হন সংসদ সদস্য।