ক্ষতিকর গ্লাইফোসেট: কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের নির্দেশ
মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ও ক্যান্সার সৃষ্টিকারী কীটনাশক গ্লাইফোসেট ব্যবহার থেকে সরে আসতে তিন মাসের মধ্যে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে গ্লাইফোসেট সমৃদ্ধ কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য গণমাধ্যমে প্রচারণার নির্দেশ দিয়েছেন।
পাশাপাশি মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর ক্ষতি সৃষ্টিকারী কীটনাশক তদারকি করতে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না এবং কেন গ্লাইফোসেট সমৃদ্ধ কীটনাশকের লাইসেন্স প্রদান এবং তা নবায়ন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত।
কৃষি সচিব, স্বাস্থ্য সচিব, বাণিজ্য সচিব, শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সচিব, খাদ্য সচিব, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের ৮ সপ্তাহের মধ্যে এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
রোববার (৫ জানুয়ারি) জনস্বার্থে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতিসহ (বেলা) ৭টি পরিবেশবাদী সংগঠনের করা রিট্ আবেদনের প্রাথমিক শুনানি শেষে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদালতে বেলার পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন সহকারী এটর্নি জেনারেল তৌফিক সাজোয়ার।
রিট আবেদনকারী অপর সংগঠনগুলো হলো— উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ), এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোস্যাল ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো), পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), শিক্ষা স্বাস্থ্য উন্নয়ন কার্যক্রম (শিসউক) ও বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইনডিজেনাস নলেজ (বারসিক)।
রিট আবেদনে গত বছর ৩১ মার্চ একটি দৈনিক বণিক বার্তায় প্রকাশিত “ক্যান্সারের ঝুঁকি, তবুও বাজারে মনসান্টোর রাউন্ডআপ”, ১৪ সেপ্টেম্বর ইংরেজি দৈনিক নিউ এইজে প্রকাশিত “ঐধুধৎফড়ঁং ঢ়বংঃরপরফবং রহ রিফব ঁংব রহ ইধহমষধফবংয”, ৯ ডিসেম্বর দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত “পাবনায় ৯০% জমির উর্বরতা কমেছে”এবং ২৪ ডিসেম্বর দৈনিক সমকালে প্রকাশিত “আমদানি কীটনাশকে ক্ষতিকর ধাতু” শীর্ষক প্রতিবেদন যুক্ত করা হয়।
রিট আবেদনে কীটনাশক নিয়ন্ত্রণে এবং গ্লাইফোসেট সমৃদ্ধ রাউন্ডআপসহ অন্যান্য কীটনাশকের আমদানি, বিক্রয়, বিপণন, ব্যবহার ইত্যাদি রোধে নির্দেশনা চায় আবেদনকারী সংগঠনগুলো।
রিট আবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালে ক্যান্সার গবেষণা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা উন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সারের (আএআরসি) প্রকাশনাতে গ্লাইফোসেট উপাদানটিকে “মানুষের জন্য সম্ভাব্য ক্যান্সারসৃষ্টিকারী” আখ্যা দেয়া হলে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বৃহৎ কৃষিপণ্য বিপণনকারী মনসান্টোর গ্লাইফোসেট সমৃদ্ধ রাউন্ডআপ-এর ক্ষতির বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে ১৩ হাজার ৪০০টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। ৩টি মামলায় ২০১৮ ও ২০১৯ সালে সানফ্রানসিসকো ও ক্যালিফোর্নিয়ার ৩টি আদালত গ্লাইফোসেট সমৃদ্ধ রাউন্ডআপ ব্যবহারে ক্যান্সার আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রচুর পরিমাণ ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ দেন।
উন্নত বিশ্ব গ্লাইফোসেট থেকে সরে আসলেও বাংলাদেশে অন্তত ৭৯ ধরনের প্রচলিত কীটনাশকে গ্লাইফোসেটের উপস্থিতি রয়েছে। মূলত ইক্ষু এবং চা বাগানে গ্লাইফোসেট সমৃদ্ধ কীটনাশক ব্যবহার করা হয়।
বেলা’র মাঠ পর্যায়ের গবেষণায় এটা স্পষ্ট হয় যে, ইক্ষু এবং চা চাষ হয় না দেশের এমন অঞ্চলেও অনিয়ন্ত্রিতভাবে গ্লাইফোসেট সমৃদ্ধ রাউন্ডআপ ও অন্যান্য কীটনাশক বিক্রি ও ব্যবহৃত হচ্ছে।
কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ এবং রাউন্ডআপসহ গ্লাইফোসেট সমৃদ্ধ অন্যান্য কীটনাশকের ব্যবহার রোধে ব্যবস্থা দাবি করে রিট আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর লিগ্যাল নোটিশ পাঠালে সরকারের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং ‘গ্লাইফোসেট ক্যান্সারের সৃষ্টি করে না’ দাবি করে। অথচ ২০১৭ সালের ৯ জানুয়ারি এবং ২০১৯ সালের ১৪ মার্চ পেস্টিসাইড টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজরি কমিটির (পিএটিসি) ৭৭তম সভার বরাত দিয়ে ২০২১ সালের মধ্যে গ্লাইফোসেটের বিকল্প পণ্য রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে এর ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।