বছরজুড়ে খেলাপি ঋণ কমানোর প্রতিশ্রুতি

  • মাহফুজুল ইসলাম,সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট,বার্তা২৪.কম,ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪র.কম

ছবি: বার্তা২৪র.কম

পুঁজিবাজারের মতো অস্থিরতার মধ্য দিয়েই আরও একটি বছর পার করলো দেশের ব্যাংকিং খাত। সরকারি ও বেসরকারি মিলে দেশে এখন ৫৮টি ব্যাংক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বছরজুড়ে ব্যাংক খাতে ছিলো খেলাপি ঋণ কমানোর প্রত্যাশা। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পাশাপাশি অর্থমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি ছিল, নতুন করে খেলাপি ঋণ বাড়বে না, বরং কমবে; পাশাপাশি কমবে ব্যাংক ঋণের সুদ হার। কিন্তু বাস্তবচিত্র ছিল উল্টো।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল দায়িত্ব নেয়ার পর ঘোষণা করেন, নতুন করে এক টাকাও খেলাপি ঋণ বাড়বে না। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২২ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা।

বিজ্ঞাপন

শুধু খেলাপি ঋণ বাড়াবে না বলে ব্যাংক মালিকরা রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা লুফে নিয়েছে। সুযোগ-সুবিধাগুলো হচ্ছে সরকারি সংস্থার আমানত ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা, নগদ জমা সংরক্ষণ (সিআরআর) কমানো, রেপো সুদহার কমানো, রেপোর মেয়াদ ২৮ দিনে বৃদ্ধি, প্রভিশনের হার ও করপোরেট কর কমানো।

এদিকে খেলাপি ও ব্যাংক ঋণের সুদ হার বৃদ্ধি অন্যদিকে ব্যাংক থেকে সরকারের লক্ষ্যমাত্রার সমান ঋণ নেয়ার ফলে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এতে উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে ঋণ পাচ্ছেন না। ফলে বেসরকারি খাতে ব্যাংকে ঋণের প্রবৃদ্ধি এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

বিজ্ঞাপন

খেলাপি ঋণ:

চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি ব্যাংক মালিকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেন, আজ থেকে আর এক টাকাও খেলাপি ঋণ বাড়বে না। এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ রয়েছে, তা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা হবে। তিনি বলেন, আজকের পর থেকে খেলাপি ঋণ এক টাকাও বাড়াতে পারবেন না। আপনারা কীভাবে বন্ধ করবেন, কীভাবে টেক কেয়ার করবেন, কীভাবে ম্যানেজ করবেন, আপনাদের ব্যাপার।

মন্ত্রী বলেন, দেশে এনপিএলের (খেলাপি ঋণ) হার ১১ থেকে ১২ শতাংশ। এর থেকে অন্য দেশে আরও বেশি। আমাদের পাশের দেশ ভারতে এনপিএল আরও বেশি। এনপিএল কমলে ব্যাংকে সুদের হারও কমে যাবে। একটির সঙ্গে আরেকটির সম্পর্ক রয়েছে। তাই আগে খেলাপি ঋণ কমানো হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংকগুলোর খেলাপি অর্থাৎ মন্দ ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা (অবলোপন ছাড়া)। সেখান থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত (অর্থাৎ গত ৯ মাস) ২২ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা বেড়ে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ৮৮২ কোটি টাকায়।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও অনেক বেশি। কারণ, অনেক ব্যাংক বড় অঙ্কের ঋণ আদায় করতে পারছে না। আবার ওই ঋণগুলোকে খেলাপি হিসেবেও চিহ্নিত করছে না।

কমেনি ব্যাংক ঋণের সুদ হার:

২০১৯ সালের ১৪ মে গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী প্রথমবারের মতো ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর আলোকে ২০১৯ সালের ২০ জুন বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সভায় সব ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশে এবং ছয় মাস মেয়াদী আমানতের সুদ হার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেয়া হয়। সুদের এই হার তারা ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর করার কথা জানায়। কিন্তু ১ জুলাই থেকে এ সিদ্ধান্ত সরকারি চার ব্যাংক ছাড়া কোনো ব্যাংকই কার্যকর করেনি।

বরং ঋণের সুদের হার কমানোর শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করে প্রায় এক বছর আগে ৬ দফা সুবিধা আদায় করে নেন ব্যাংকের পরিচালকরা। এগুলো হচ্ছে-সরকারি সংস্থার আমানত ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা, নগদ জমা সংরক্ষণ (সিআরআর) কমানো, রেপো সুদহার কমানো, রেপোর মেয়াদ ২৮ দিনে বৃদ্ধি, প্রভিশনের হার ও করপোরেট কর কমানো।

এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে সরকারি সংস্থার মোট আমানতের ২৫ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা যেত, বাকি ৭৫ শতাংশ রাখতে হতো সরকারি ব্যাংকে। ব্যাংক মালিকদের দাবির মুখে আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার বিধান করা হয়। ফলে বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় তারল্য প্রবাহ বাড়ে।

নগদ জমা সংরক্ষণের হার (সিআরআর) ১ শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ করা হয়। এতে ব্যাংকগুলোয় তারল্য প্রবাহ বেড়ে যায়। ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেয়ার উপকরণ রেপোর সুদের হার দশমিক ৭৫ শতাংশ কমিয়ে ৬ শতাংশ করা হয়। এর মেয়াদ ৭ দিন থেকে বাড়িয়ে ২৮ দিন করা হয়। এতে বেশি মেয়াদে কম সুদে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। গত অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমানো হয়। ফলে তাদের মুনাফার পরিমাণ বেড়েছে।

ব্যাংকগুলোকে আগে রফতানি বিল কেনা ও ব্যাংক গ্যারান্টির বিপরীতে ১ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হতো। এখন এটি তুলে নেয়া হয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোর এ খাতে তহবিল আটকে থাকার পরিমাণ কমেছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এসব সিদ্ধান্তের ফলে ব্যাংকগুলোর হাতে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত তহবিল এসেছে। এর প্রভাবে কমেছে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয়। এরপরও ব্যাংকগুলো কমাচ্ছে না ঋণের সুদের হার। অথচ ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার শর্তেই এসব সুবিধা নিয়েছে ব্যাংকগুলো।

ব্যাংক ঋণ নির্ভর সরকার:

২০১৯-২০ অর্থ বছরের বাজেটে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ৪৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। জুলাই থেকে ৩১ নভেম্বর মোট পাঁচ মাসেই ৪৭ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এখনো বাকি অর্থবছরের সাত মাস। সরকার এ খাত থেকে আরও বেশি ঋণ নিতে চাপ সৃষ্টি করছে।

একদিকে খেলাপি ঋণ ও ব্যাংকের ঋণের সুদ বেশি।অন্যদিকে সরকার ব্যাংকিং সেক্টর থেকে ঋণ নিচ্ছে বেশি ফলে ব্যাংক খাতে তারল্য সঙ্কট তৈরি হয়েছে। আর তাতে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ফলে একদিকে উচ্চ সুদ অন্যদিকে চাহিদা মতো ঋণ পাচ্ছে না। এ কারণে উদ্যোক্তারা সঠিকভাবে ব্যবসা করতে পারছে না, যা অর্থনীতির জন্য কোনো সুখকর সংবাদ নয়।

নতুন ব্যাংকের অনুমোদন:

খেলাপি ঋণ ও বিভিন্ন অনিয়মের কারণে যে মুহূর্তে তফসিলি ব্যাংকগুলো টিকে থাকতে পারছে না, একীভূত হতে যাচ্ছে, ঠিক সে মুহূর্তে কমিউনিটি ব্যাংক লিমিটেড, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক, দ্য সিটিজেন ব্যাংক ও পিপলস ব্যাংক লিমিটেড- তিনটি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হলো।

এর মধ্যে বাংলাদেশের মালিকানাধীন পুলিশদের জন্য 'কমিউনিটি ব্যাংক লিমিটেড' কার্যক্রম শুরু করেছে। কিন্তু বাকি তিনটি ব্যাংক বেঙ্গল কমার্শিয়াল, দ্য সিটিজেন ও পিপলস ব্যাংক কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি।

সর্বশেষ গত রোববার (১ ডিসেম্বর) খেলাপি ঋণ কমানোর পাশাপাশি ব্যাংক ঋণের সুদ হার কমিয়ে (সিঙ্গেল ডিজিট) আনতে সাত সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

ওই দিন অর্থমন্ত্রী বলেন, এই কমিটি কী কারণে খেলাপি ঋণ ও সুদ হার বাড়ে, তার কারণ খুঁজে বের করবে। এছাড়া কী পদক্ষেপ নিলে খেলাপি ঋণ কমানো যাবে, তার সুপারিশ দেবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সেই অনুসারে কাজ করবে।

সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করলে ৩১ ডিসেম্বরের পর থেকে খেলাপি ঋণ ও ব্যাংক ঋণের সুদ হার কমবে বলেও আশা প্রকাশ করে তিনি।