জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমান সম্পূর্ণভাবে জড়িত ছিল
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারী কর্নেল ফারুক, কর্নেল রশিদ, মেজর হুদা, মেজর ডালিমসহ সবার নাম উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তারা সকলেই সামরিক অফিসার ছিল। এই সামরিক অফিসারদের কারা, কে মদদ দিয়েছিল, তাদের পেছনে কারা ছিল? জিয়া একজন মেজর ছিলেন। জাতির পিতা তাকে পদোন্নতি দিয়ে মেজর জেনারেল বানিয়েছিলেন। সে এর সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে জড়িত ছিল। সেটা স্পষ্ট পাওয়া যায়— এই হত্যাকাণ্ডের পর বিবিসিতে কর্নেল ফারুক ও কর্নেল রশিদের ইন্টারভিউতে। যেখানে তারা স্পষ্ট বলে যে তাদের সঙ্গে জিয়াউর রহমান সম্পূর্ণভাবে জড়িত ছিল। তার মদদেই তারা এই ঘটনা ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল। এবং সেটা আরও প্রমাণ হয় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর, রাষ্ট্রপতিকে হত্যার পর, সেখানে সংবিধান মানা হয়নি, ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম কিন্তু সেখানে রাষ্ট্রপতি হননি, রাষ্ট্রপতি ঘোষিত হলো খন্দকার মোশতাক। আর খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি হয়েই জেনারেল জিয়াকে বানালো সেনাবাহিনীর প্রধান।
রোববার (১৬ আগস্ট) বঙ্গবন্ধুর ৪৫তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী একথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জেনারেল জিয়া যদি এই ষড়যন্ত্রে মোশতাকের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকবে, তাহলে কেন মোশতাক তাকেই বেছে নিবে সেনাপ্রধান হিসেবে? তারপর খুনীদের সব ধরনের মদদ দেওয়া, এটাতো জিয়াউর রহমানই দিয়েছে। এবং এখানেই তাদের শেষ না। মোশতাক বেঈমানরা কখনো ক্ষমতায় থাকতে পারে না। মীর জাফর পারেনি। মীর জাফরকে যারা ব্যবহার করেছে সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করতে। মীর জাফর দুই মাসের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। ঠিক মোশতাকও পারেনি। মোশতাককে হটিয়ে জিয়াউর রহমান নিজেকে নিজেই ঘোষণা দিয়েছিল রাষ্ট্রপতি হিসেবে।
‘এই খুনীরা যারা শুধু ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডই ঘটায়নি। ৩রা নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যার হত্যাকাণ্ড ঘটায়। তাদেরকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া, তাদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা। বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে জিয়াউর রহমান খুনীদের পুরস্কৃত করে। খুনীদের বিচার হবে না। ১৫ আগস্টের হত্যার বিচার হবে না। সেই ইনডেমনিটি অর্ডিনেন্স জারি করা হয়। তাদের বিচারের পথ বন্ধ করা হয়। আমরা যারা আপনজন হারিয়েছি, আমাদের মামলা করার অধিকার ছিল না, বিচার করারও অধিকার ছিল না।’
তিনি বলেন, ৭৫’র পর আমি আর রেহানা বিদেশে ছিলাম। ঘাতকের নির্মম বুলেটে যারা আপনজন হারিয়েছিল, অনেকে দেশে থাকতে পারেনি। সেদিন হত্যার পর পরশ-তাপসকে খুঁজে বেড়ানো হয়েছে। কারা কারা বেঁচে আছে, তাদের খুঁজে বেড়ানো হয়েছে। সকলেই গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল ভারতের মাটিতে। রিফিউজি হিসেবে আমাদের থাকতে হয়েছিল। এমনকি আমরা আমাদের নিজেদের নামটাও ব্যবহার করতে পারিনি। একদিকে আপনজন সব হারিয়েছি। একদিনের মধ্যে সব শেষ। তারপর রিফিউজি হিসেবে আমাদের থাকতে হয়েছে। আমরা যখন রিফিউজি হিসেবে থেকেছি বিদেশের মাটিতে অবস্থান করে, আর ঘাতকের দল তখন বিভিন্ন দূতাবাসে রাষ্ট্রদূতের চাকরি পেয়ে বা দূতাবাসে বিভিন্ন সরকারি চাকরি পেয়ে তারা আরাম-আয়েশে জীবন যাপন করে, তা আমাদের দেখতে হয়েছে। অথচ এই দেশ স্বাধীন করে গেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৮০ সালে আমি লন্ডনে যাই। রেহানা তার আগেই লন্ডনে গিয়েছিল। ১৯৮০ সালের ১৬ আগস্ট আমরা লন্ডনে এই হত্যার প্রতিবাদে সভা করি। তখন সেখানে স্যার টমাস ইউলিয়াম কিউসি এমপি এবং নভেল লরেট শন ম্যাক ব্রাইট তাদেরকে নিয়ে একটা আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। সেদিনই সেই তদন্ত কমিশনের ঘোষণা দেওয়া হয়। সেই তদন্ত কমিশনকে আমাদের প্রবাসী বাংলাদেশিদের সহযোগিতায় সেই তদন্ত কমিশনের প্রতিনিধি হিসেবে জাতির পিতা ও রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার তদন্তের জন্য পাঠানো হয়। ব্রিটিশ এমপি অনেকে তখন আমাদের সহযোগিতা করে। তিনি যখন ভিসা চান, জিয়াউর রহমান তখন রাষ্ট্রপতি, জিয়াউর রহমান কিন্তু টমাস উইলিয়ামকে ভিসা দেয়নি।
‘জিয়াউর রহমান কেন ভিসা দিলো না। কেন তদন্ত করতে দিলো না। এই প্রশ্নটা থেকে যায়। কারণ খুনের সঙ্গে জড়িত ছিল বলে সে ভয়ে ভীত ছিল। সে তদন্ত করতে দেয়নি। তারা খুনীদের লালন পালন করে গেছে।’
তিনি বলেন, ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগ যখন আমাকে সভাপতি নির্বাচিত করলো। যখন আমি বাংলাদেশে ফিরে আসি। তখনো ৩২ নম্বরের বাড়িতে আমাকে ঢুকতে দেয়নি। ৩২ নম্বরের রাস্তায় বসে আমরা মোনাজাত করি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। শোক দিবস পালন করা যাবে না, তার কথা বলা যাবে না। ইতিহাসকে সম্পূর্ণ বিকৃত করা হয়। স্বাধীনতা বিরোধীদের, রাজাকার, আল বদরদের জিয়াউর রহমান মন্ত্রী বানিয়েছে, রাজনীতি করা সুযোগ দিয়েছে, তাদের ভোটের অধিকার, এই সমস্ত লোকদের নির্বাচন করার অধিকার ছিল না। ভোট দেওয়ার অধিকার ছিল না। সংবিধানের ১২ ও ৩৮ অনুচ্ছেদ বাতিল করে তাদের সংগঠন করা, নির্বাচন করার অধিকার দিয়েছে। লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত আমাদের স্বাধীনতাকে ধুলিস্যাৎ করে বাংলাদেশকে ভিন্ন পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসকে সম্পূর্ণ বিকৃত করা হয়েছিল। কোথাও জাতির পিতা নাম থাকলে সেটা মুছে ফেলা হতো।
তিনি আরও বলেন, খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে কী করেছিল ১৯৯৬ সালে? বাংলাদেশে একটা ভোটারবিহীন নির্বাচন হয়েছিল। কোনো দল অংশগ্রহণ করেনি। … নির্বাচনের নামে প্রহসন করেছিল। সারা বাংলাদেশে সেনাবাহিনী মোতায়েন করে দিয়ে সে নির্বাচন করার চেষ্টা করা হয়েছিল। ভোটাররাও ভোট দিতে আসেনি। তারপর খালেদা জিয়া নিজেকে নির্বাচিত ঘোষণা দিলো। আর সে নির্বাচনে কর্নেল রশিদকে নির্বাচিত করা হলো। মেজর হুদাকে নির্বাচিত করা হলো। তাদেরকে পার্লামেন্টে বসানো হলো। খুনী কর্নেল রশীদকে বিরোধী দলের আসনে বসানো হয়েছিল। খালেদা জিয়ার খুনীদের প্রতি এত দরদ কেন ছিল?
‘এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিংয়ের কথা আজকে সবাই বলে— সবাই ভুলে গেছে যে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসার পর অপারেশন ক্লিন হার্টের নামে বহু মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। অপারেশন ক্লিন হার্টের নামে যত্রতত্র যেখানে-সেখানে মানুষকে ধরে নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে যুবলীগের কর্মী যাকে যেখানে পেয়েছে নিয়ে হত্যা করেছে। আর সেই হত্যার বিচার হবে না। সেই হত্যার বিচার হবে না সেই ইনডেমনিটিও খালেদা জিয়া দিয়ে গেছে। তার স্বামী দিয়ে গেছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের ইনডেমনিটি। আর সে এসে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে তাদের ইনডেমনিটি দিয়ে গেছে।
আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এছাড়া বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, ঢাকা দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফি, ঢাকা উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান।