১৫ আগস্টের কুশীলবদের মুখোশ উন্মোচনে কমিশন গঠনের দাবি
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে নায়কদের খুঁজে বের করতে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করার প্রস্তাব ১৪ দলের সভায় গ্রহণ করা হয়েছে। পাশাপাশি এই প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তুলে ধরার দাবি জানিয়ে জিয়াউর রহমান ও খন্দকার মোশতাকসহ কুশীলবদের মুখোশ উন্মোচন করার দাবি উঠে সভায়।
বুধবার (১৯ আগস্ট) জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে ১৪ দলের ভার্চুয়াল সভায় এসব দাবি উত্থাপন করেন কেন্দ্রীয় নেতারা। পরে ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র এবং আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু এই প্রস্তাব গ্রহণ করা যেতে পারে বলে মত দেন।
সভাপতির বক্তব্যে আমির হোসেন আমু বলেন, এই সভার অনেকেই প্রস্তাব করেছেন ১৫ আগস্টের কুশীলবদের মুখোশ উন্মোচনে তদন্ত কমিশন গঠন করার। কমিশন গঠন করার মধ্য দিয়ে তদন্ত করা হোক কারা এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে নায়ক ছিলেন। আমি মনে করি ১৪ দলের পক্ষ থেকে যে দাবি জানানো হয়েছে তা গ্রহণ করা যেতে পারে।
তিনি বলেন, ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের কালরাতে জাতির জনককে সপরিবারে হারিয়েছিলাম। সেদিন থেকেই হারাতে শুরু করেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ। যে চার নীতির ভিত্তিতে সংবিধান রচিত হয়েছিল সেই জাতীয় চার নীতি ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। এই দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কোনো অনুমোদন ছিল না সংবিধানে, সেটা তুলে দিয়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছিল। গোলাম আযমের নাগরিকত্ব না থাকার পরেও তাকে নাগরিকত্ব দিয়ে দেশে এনে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। এই দেশকে একটি নব্য পাকিস্তানি করবার ষড়যন্ত্র নিয়েই ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল। ১৯৭১ সালের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘটিয়েছিল।
আমু বলেন, জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বিল পাস করেছিল। হত্যাকারীদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছিল। বঙ্গবন্ধুর আমলে সাড়ে ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী কারাগারে বন্দী ছিল, তাদের মধ্যে সাড়ে ৪০০ লোকের বিভিন্ন রকমের সাজা হয়েছিল। সেই সাজাপ্রাপ্তের মধ্যে ৫২ জনের ফাঁসির আদেশ হয়েছিল, একজনের ফাঁসির আদেশ কার্যকরও হয়েছিল। কিন্তু জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে সেই সকল যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি করে দিয়েছিল, শাহ আজিজের মতো লোককে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিল। জিয়াউর রহমান এই দেশে পরাজিত শক্তিদের জাতীয়-আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেয়।
বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শন তুলে ধরে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়নি, আমাদের স্বাধীনতার চেতনা ও মূল্যবোধকে হত্যা করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী কয়েকজন খুনির জবানবন্দিতে এটা পরিষ্কার যে জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল এতে কোনো সন্দেহ নেই। পাকিস্তানিরা পারেনি কিন্তু খন্দকার মোশতাক ও জিয়া দেশি-বিদেশি ষড়ন্ত্রের মাধ্যমে সেদিন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছিল।
তিনি বলেন, সময় এসেছে একটা কমিশন গঠন করে তদন্ত করার। কারা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল, যারা বিদেশি তারা কারা? তদন্ত করলে প্রকৃত কুশীলবরা বেরিয়ে আসবে।
মোফাজ্জেল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চেয়ে বহুদিন রাজপথে দাবি করে আসছি কিন্তু আমাদের কথা কেউ শোনেনি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করার পর বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসি হয়েছে। অনেকে পালিয়ে বিদেশে রয়েছে। আশাকরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সরকার পলাতক খুনিদের ধরে এনে ফাঁসির রায় কার্যকর করবে।
তিনি বলেন, খুনি যারা তাদের রায় হয়েছে, কিন্তু তাদের মূল পরিকল্পনাকারী, ষড়যন্ত্রকারী তারা কিন্তু আড়ালে রয়েছে। বারবার দেশের মানুষ জানতে চায় মূল পরিকল্পনাকারী কারা? কারা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেছিল? যদি পরিকল্পনাকারীদের সঠিকভাবে ধরা না হয় তাহলে ষড়যন্ত্র চলছে, চলতেই থাকবে। যদি মূল ষড়যন্ত্রকারীদের ধরা হয় ষড়যন্ত্র চিরতরে ধ্বংস হবে। এজন্য কমিশন গঠন করে খুনি জিয়াসহ কুশীলবদের বের করে আনতে হবে।
ড. হাছান মাহমুদ বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রকে হত্যা করার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। যারা স্বাধীনতা চায়নি যে আন্তর্জাতিক শক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমাদের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা পাকিস্তানের চর হিসেবে যারা আমাদের মাঝে ছিল তারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। নীল নকশার মাধ্যমে দেশকে হত্যা করার জন্য আমাদের স্বাধীনতা হত্যা করার লক্ষ্যে হত্যাকাণ্ড হয়েছিল।
রাশেদ খান মেনন বলেন, ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড কোনো ব্যক্তির হত্যা ছিল না, এটা ছিল রাজনীতিকে হত্যা, বাংলাদেশকে পিছিয়ে দিতে মুক্তিযুদ্ধের পথ থেকে সরিয়ে আনতে এবং স্বাধীনতার ঘোষণা সামাজিক ন্যায় বিচারের থেকে সরিয়ে নেওয়ার হত্যাকাণ্ড। জিয়া সংবিধান খণ্ডবিখণ্ড করেছে। সময় এসেছে একটি কমিশন গঠন করে কুশীলবদের খুঁজে বের করার।
হাসানুল হক ইনু বলেন, ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকাণ্ড অবিচ্ছন্ন ঘটনা নয়। শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির হত্যাকাণ্ড নয় বা ক্ষমতার রদবদলের হত্যাকাণ্ড নয় এটা সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করা হয়নি, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র এবং সংবিধানের আত্মাকে ধ্বংস করার অপচেষ্টা করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথ থেকে সরিয়ে নিয়ে পাকিস্তান পন্থার পথে সাম্প্রদায়িকতার পথে অপরাজনীতির পথে বাংলাদেশকে ঠেলে দেওয়ার একটা চেষ্টা মোস্তাক এবং জেনারেল জিয়াউর রহমান গং করেছিলেন।
তিনি বলেন, জাতিকে সঠিক ইতিহাস চর্চা করার জন্য বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে নায়কদের স্বরূপ উন্মোচনে ১৪ দলের পক্ষ থেকে একটি শক্তিশালী জাতীয় কমিশন গঠন করার প্রস্তাব করছি। কমিশন গঠন করে তদন্ত করা হলে নেপথ্যে নায়করা বেরিয়ে আসবে।
১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আমির হোসেন আমুর সভাপতিত্বে ভার্চুয়াল সভায় বক্তব্য রাখেন, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ, মোফাজ্জেল হোসেন চৌধুরী মায়া, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ডা. হাছান মাহমুদ, ওয়াকার্স পাটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাম্যবাদী দলের সভাপতি দিলীপ বড়ুয়া, শরিফ নুরুল আম্বিয়া, তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী। এছাড়া অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক মৃনাল কান্তি দাস প্রমুখ।