ফেসবুকে ‘সুন্দরী’ বেশে প্রলোভন, নাইজেরীয় চক্রের খপ্পরে তরুণরা

  • শাহরিয়ার হাসান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

গ্রেফতার অবৈধ নাইজেরীয় চক্র/ছবি: সংগৃহীত

গ্রেফতার অবৈধ নাইজেরীয় চক্র/ছবি: সংগৃহীত

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্ধুত্ব করে বিভিন্ন দেশের মানুষকে উপহার দেওয়া নামে প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে আসছে দেশে থাকা অবৈধ নাইজেরিয়ান একটি চক্র। চলতি মাসে রাজধানীতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হাতে ৬০ জনের বেশি নাইজেরিয়ান গ্রেফতার হয়েছে। এসব নাইজেরিয়ানদের বেশিরভাগেরই নেই বাংলাদেশে থাকার কোনো বৈধতা।

নতুন নতুন কায়দায় দেশের মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে এই চক্রটি। কখনও চাকুরি দেওয়ার নাম করে, কখনও লটারি পেয়েছেন এমন এসএমএস বা মেইল পাঠিয়ে, আবার তরুণ-তরুণীদের বিদেশ থেকে দামি উপহার পাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণা করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ব্যবহারকারী সহজ-সরল সাধারণ মানুষ বিশেষ করে তরুণীরা এই প্রতারণার শিকার বেশি হচ্ছেন।

বিজ্ঞাপন

তথ্য বলছে, গত তিন বছরে তিন শতাধিক বিদেশি অপরাধীকে গ্রেফতার করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বাংলাদেশে ফেসবুকে উপহার পাঠানোর নামে প্রতারণা, হেরোইন, কোকেন এটিএম বুথে জালিয়াতি, বিভিন্ন দেশের জাল মুদ্রার কারবার, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, স্বর্ণ  চোরাচালান, অনলাইনে ক্যাসিনো এবং মানবপাচারে জড়িত থাকার তথ্য পাওয়ার গেছে।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র বলছে, বাংলাদেশে সক্রিয় এসব অপরাধীর নেটওয়ার্ক প্রতিবেশী দেশসহ অন্তত আটটি দেশে বিস্তৃত। বিদেশিদের ওপর সমন্বিত কোনো নজরদারি নেই দেশে। নেই সঠিক পরিসংখ্যানও। অপরাধ করে গ্রেফতারের পর জামিনে ছাড়া পেয়ে আত্মগোপনে থেকে ফের অপরাধে জড়াচ্ছে তারা। আর তাদের এসব কাজে সহযোগিতা করছে স্থানীয় কিছু অপরাধী চক্র।

বিজ্ঞাপন

সর্বশেষ (২৮ আগস্ট) শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে চক্রটির ১৫ জন নাইজেরিয়ান নাগরিককে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এসময় প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত নয়টি ল্যাপটপ, ২২টি মোবাইল ও পাঁচটি হিসাবের ডায়েরি উদ্ধার করা হয়েছে।

জানতে চাইলে সিআইডির অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) শেখ রেজাউল হায়দার বার্তা২৪.কমকে বলেন, এই চক্রটি মার্কিন নারী সেনা কর্মকর্তা বা ‘সুন্দরী’ নারী সেজে ভুয়া ফেসবুক আইডি বা হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে ব্যক্তিগত ছবি পাঠিয়ে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। পরবর্তীতে মেসেজের মাধ্যমে তারা জানায়, সে ইয়েমেন/আফগানিস্থান বা সিরিয়াতে আছে এবং তার কাছে কয়েক মিলিয়ন ডলার রয়েছে। কিন্তু ওই দেশে যুদ্ধ চলমান থাকায় যেকোনো সময় মূল্যবান সম্পদ নষ্ট হতে পারে। তাই নতুন বন্ধুকে ওই সম্পদ উপহার দিতে চায়। যদি সে বেঁচে ফেরে তাহলে পরে তা ফেরত নেবে। এই ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে প্রথমে বন্ধুদের ঠিকানাসহ মোবাইল নম্বর নেয় এবং ওই ঠিকানায় বন্ধুদের মেসেঞ্জারে/হোয়াটসঅ্যাপে উপহারের প্যাকেটের ছবি পাঠায়।

পরবর্তী মেসেজে কোনো একটি এয়ারলাইনসে প্যাকেটের বুকিং দেওয়া হয়েছে এমন রসিদ পাঠায়। ঠিক দুইদিন পর বন্ধুর (ভুক্তভোগীর) মোবাইলে ফোন করে ভিডিও কলে এয়ারপোর্ট কাস্টমস অফিসে থাকা উপহার প্যাকেট দেখায় এবং কাস্টমসের ভ্যাট বাবদ বিভিন্ন ধাপে টাকা নিতে থাকে।

সিআইডির এই কর্মকর্তা জানান, ফরহাদ হোসেন তালুকদার নামে এক ভুক্তভোগী প্রতারণার শিকার হয়েছে বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে এ পর্যন্ত ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা দিয়েছে। পরবর্তীতে সংবাদমাধ্যমে জানতে পেরে আর টাকা না পাঠিয়ে তিনি সিআইডিকে জানান।

এই চক্রটি পুনরায় টাকা চেয়ে ফোন করলে পুলিশ, সিআইডির দিক নির্দেশনায় কাস্টমস কর্মকর্তা পরিচয় দেওয়া মোবাইল, ল্যাপটপসহ বিপুল পরিমাণ আলামতসহ গ্রেফতার করা হয়।

এ চক্রটি ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাই, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের মানুষকে এভাবে বোকা বানিয়ে উপহার দেওয়ার নামে স্ব-স্ব দেশের সহযোগী ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এরা একটি আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্র, তাদের সহযোগীরা উল্লেখিত দেশে অবস্থান করছে।

কতজন বিদেশি নাগরিক অবৈধভাবে আছে তা জানতে চাইলে রেজাউল হায়দার বলেন, ‘আমাদের দেশে এরকম প্রতারণার সঙ্গে জড়িত কতজন নাইজেরিয়ান, ক্যামেরুন, উগান্ডা ও কেনিয়াসহ অন্যান্য দেশের নাগরিক আছে তার সঠিক তথ্য জানা নেই। গত কয়েক দিনে ৩০ থেকে ৪০ জন ভিকটিম আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। আরও অসংখ্য মানুষের সঙ্গে তারা প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আমরা ব্যাংক হিসাবগুলোতে অনুসন্ধান চালাচ্ছি।

এদিকে এবিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) আবদুল বাতেন বার্তা২৪.কমকে বলেন, নাইজেরিয়ান আফ্রিকানসহ অনেক বিদেশি ভিসার মেয়াদ শেষ হলে পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলে। কিছু বাংলাদেশি টাকার লোভে তাদের অপরাধ কর্মকাণ্ডে সহায়তা করে। তাদের ধরার পর জামিনে বেরিয়ে গা ঢাকা দেয়।

কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশে নাইজেরিয়ান/আফ্রিকান প্রতারক চক্র ফাঁদ পেতে বসে আছে। নিজেদের উন্নত দেশের নাগরিক পরিচয় দিয়ে তারা মেয়েদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করেও প্রতারণা করছেন। নারীদের ব্যক্তিগত ছবি নিয়ে ব্ল্যাক মেইলও করছেন তারা।’

মনিরুল ইসলাম অপরিচিত কারও দেওয়া উপহার বা প্রলোভনে আশ্বস্ত না হওয়ার আহ্বান জানান। একইসঙ্গে এ ধরনের কোনও অফার আসলে পুলিশকে জানানোর অনুরোধও করেন তিনি।