কুমিল্লায় ‘বেপরোয়া’ হয়ে উঠেছে বালু খেকোরা!
কুমিল্লা জেলায় বালু খেকোরা অনেক বেশি ‘বেপরোয়া’ হয়ে উঠেছে। জেলা সদর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও একই অবস্থা। জেলার ১৭টি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে নদী, খাল-বিল ও ফসলি জমি থেকে অবৈধভাবে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করছে তারা। এরপর ট্রাকে করে এসব বালু বিক্রি করছে বিভিন্ন স্থানে।
জেলা ও স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনগুলো একাধিকবার এসবের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বরং প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বালু খেকোরা প্রকাশ্যেই এসব অপকর্ম করে যাচ্ছে।
যদিও জেলা প্রশাসন বলছে, এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে তাদের অভিযান চলমান রয়েছে।
এদিকে, জেলার বিভিন্ন উপজেলায় পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে একের পর এক পুকুর ও জলাশয় ভরাট করা হচ্ছে। এছাড়া অবাধে কৃষিজমি থেকে বালু-মাটি উত্তোলনের ফলে হুমকির মুখে পড়েছে ফসলি জমি। অনেক এলাকায় অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে কৃষিজমি। অনেক সময় ভুক্তভোগীরা বালু উত্তোলন বন্ধে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করলেও দৌরাত্ম্য কমছে না তাদের।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত গোমতী নদীর আদর্শ সদর উপজেলার অংশেই অন্তত ৩০টি এলাকা থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। নদীর চরের কৃষিজমিগুলোও ছাড় দিচ্ছে না বালু খেকোরা। অপরিকল্পিতভাবে নদী এবং চরের কৃষি জমিগুলো থেকে বালু উত্তোলনের ফলে গোমতী নদীর শহর রক্ষা বাঁধও হুমকির মুখে রয়েছে।
গত রোববার গোমতী চরের সদর উপজেলার শাহপুর ও গোলাবাড়ি এলাকায় অভিযান চালিয়েছে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অমিত দত্ত। তিনি এ সময় অবৈধভাবে কৃষিজমির উপর ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলন ও কৃষিজমি নষ্ট করার অপরাধে এক ব্যক্তিকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। গত ১৪ সেপ্টেম্বরও একই এলাকায় অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকজনকে মৌখিকভাবে সতর্ক করেন। ওইদিনও কৃষিজমির উপর ড্রেজার মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের অপরাধে এক ব্যক্তিকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই গোমতী নদীর বালুমহাল নিয়ে বর্তমানে দু’টি পক্ষ সরাসরি বিরোধে জড়িয়েছে। নদীর সদর উপজেলার ৫টি বালুমহালের বর্তমান ইজারাদার মেসার্স এম রহমান নামক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক মাহবুবুর রহমানের দাবি, সাবেক ইজারাদার আরফানুল হক রিফাত ও তার লোকজন অবৈধ দখলের মাধ্যমে গোমতী নদীর ১৩টি ঘাট এবং সঙ্গে ২৫টি স্থানে নৌকায় ড্রেজার বসিয়ে নদী থেকে বালু উত্তোলন করছেন।
আর মেসার্স রিফাত কনস্ট্রাকশনের মালিক আরফানুল হক রিফাতের দাবি, মাহবুবুর রহমান অবৈধ টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ৫টি বালুমহাল ইজারা নিয়ে নদীর মোট ২৯টি অংশ দখল করেছেন এবং অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছেন। নদীর বালু উত্তোলন নিয়ে দুই পক্ষের এই বিরোধ কুমিল্লার আদালত এবং উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।
সরেজমিনে জেলার মনোহরগঞ্জে গিয়ে দেখা গেছে, উপজেলার শাকতলা গ্রামে ফসলি জমিতে কয়েকটি ড্রেজার বসিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে মোট দু’টি গ্রামের ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি হুমকির মুখে পড়েছে। ভুক্তভোগীরা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাননি। একই উপজেলার ডাকাতিয়া নদীর হাওরা সেতুর কয়েক গজ দূরেই ড্রেজার মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে প্রভাবশালীরা। একই নদীর পোমগাঁও এলাকাতেও বসানো হয়েছে বেশ কয়েকটি ড্রেজার।
জেলার ব্রাহ্মণপাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে, উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ফসলি জমি থেকে অবাধে ড্রেজার মেশিন দিয়ে অবৈধভাবে বাণিজ্যিক বালু-মাটি উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে দিন দিন উজাড় হচ্ছে ফসলি জমি। উপজেলার ধান্যদৌল এলাকায় ফসলি জমি থেকে বেশ কয়েটি ড্রেজার মেশিন দিয়ে মাটি-বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। কল্পবাস গ্রামেও একই অবস্থা। এ উপজেলায় দীর্ঘদিন ধরে ফসলি জমি থেকে বালু উত্তোলনের ফলে কমে গেছে ফসলি জমির পরিমাণ।
এদিকে, জেলার চান্দিনা উপজেলা সদরেই চলতি বছরে ৩টি বড় পুকুর অবৈধভাবে ভরাট করা হয়েছে। সম্প্রতি উপজেলা সদরের সাহাপাড়া এলাকার বিশাল আরও একটি পুকুর ভরাট করেছে প্রভাবশালীরা।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এই পুকুরটি ভরাট করার ফলে এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে এবং দুর্ভোগে পড়েছে অন্তত অর্ধশত পরিবার।
জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার উজিরপুর ও কালিকাপুর ইউনিয়নে গিয়ে কমপক্ষে ১০টি স্থানে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করতে দেখা গেছে। শুধুমাত্র এই কয়েকটি উপজেলাই নয়, জেলার ১৭টি উপজেলারই প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে এখন হিড়িক পড়েছে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের।
জেলার মনোহরগঞ্জের কৃষক আলী আকবর, ব্রাহ্মণপাড়ার কৃষক সামছুল আলমসহ অন্তত ১০ জন জানান, অবৈধভাবে বালু-মাটি উত্তোলনের কারণে কৃষিজমি এখন হুমকির মুখে। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম এলেই বেপরোয়া হয়ে উঠে বালু খেকোরা। তারা প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের ম্যানেজ করেই এই অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এখনই এসব বালু খেকোদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে এক সময় কৃষিজমির অস্তিত্ব থাকবে না বলেও জানান তারা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. আবুল ফজল মীর বলেন, ‘আমরা যেখানেই এমন অভিযোগ পাচ্ছি, সেখানেই অভিযান চালাচ্ছি। আর এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। অবৈধ বালু ও মাটি উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে আমাদের ব্যবস্থা গ্রহণ সারাবছরই চলমান থাকে। এ কাজে পুলিশ ও র্যাব বর্তমানে আমাদের সঙ্গে কাজ করছে। অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের কোনো ভাবেই ছাড় দেয়া হবে না বলে জানান তিনি।