বিনা বেতনে শিক্ষকতায় অবসরে প্রতিবন্ধী হাফিজার
প্রতিবন্ধী হাফিজার রহমান। গাইবান্ধার সাদুল্লাহপুর উপজেলার দুর্গাপুর কাদেরিয়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসায় ক্বারী শিক্ষক হিসেবে দীর্ঘ ৩৩ বছর শিক্ষকতা করেছেন। এতো বছর পরও প্রতিষ্ঠানটি হয়নি এমপিওভুক্ত। ফলে বিধি মোতাবেক বিনা বেতনে চাকরি থেকে অবসরে যেতে হয়েছে প্রতিবন্ধী হাফিজার রহমানকে।
সোমবার (২৬ অক্টোবর) দুপুরে নিজ বাড়ির উঠানে এসব তথ্য জানালেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক হাফিজার রহমান। এসময় চোখে-মুখে দেখা গেছে চরম হতাশার গ্লানি। এমন কি অশ্রুজলও ঝরছিলো তার।
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক হাফিজার রহমানের বাড়ি গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার জামালপুর ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের মৃত মিয়াজান আকন্দের ছেলে এবং স্থানীয় দুর্গাপুর কাদেরিয়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসায় ক্বারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
জানা যায়, সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন নিয়েই পৃথিবীর আলোর মুখ দেখেন হাফিজার রহমান। এরপর বয়স যখন ৩ বছর, তখন টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়। এ রোগের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থেকে একটি পা বিকলাঙ্গ হয় তার। সেই থেকে লাঠিতে ভর করে চলতে হয় তাকে। তবে প্রতিবন্ধী হলেও মনোবল হারাননি কখনো। দৃঢ় মনোবল নিয়ে ১৯৭২ সালে গাইবান্ধা মর্ডান হাইস্কুল থেকে দ্বিতীয় বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হয়। পরিবারের অভাব অনটনের কারণে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করা সম্ভব হয়নি তার। তবে এসএসসি সার্টিফিকেট কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠিত হবেন, এমন স্বপ্নে ১৯৭৬ সনে দুর্গাপুর কাদেরিয়া ফুরকানীয়া মাদরাসায় শুরু করেন শিক্ষকতা পেশা। ধারাবাহিকতায় ১৯৮৪ সনে এ প্রতিষ্ঠানটি ফুরকানীয়া থেকে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এসময় ক্বারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন হাফিজার রহমান। এরই মধ্যে বিয়ে করেন ফেরেজা বেগম নামের আরেক প্রতিবন্ধীকে। দাম্পত্য জীবনে তাদের রয়েছে ২ ছেলে ও ২ মেয়ে সন্তান।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বেতনবিহীন শিক্ষকতা জীবনে হাফিজার রহমানের সংসারে শুরু হয় টানাপোড়েন। নিজের কিছু জমির ফসল উৎপাদনের আয় দিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে কোনোমতে দিনাতিপাত করছেন তিনি। তবুও বেতনবিহীন শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে দেয়নি কখনো। মাদরাসাটি এমপিওভুক্ত হলে বেতন-ভাতা পাবেন, এমন স্বপ্নে পাঠদান দিয়ে আসছিলেন শিক্ষার্থীদের। এভাবে সুনামের সহিত শিক্ষকতায় ৩৩ বছর পার করলেও তার কপালে জোটেনি সরকারের বেতন-ভাতা। কারণ, প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত না হতেই চাকরি বিধি মোতাবেক ২০০৯ সালে বিনা বেতনে অবসর গ্রহণ করতে হয় হাফিজার রহমানকে।
বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত ওই শিক্ষকের নানান রোগ বাসা বেধেছে শরীরে। এখন আর আগের মতো লাঠিতে ভর করে তেমন চলতে পারেন না । এছাড়া ভালো কিছু খেয়েপড়ে বেঁচে থাকবেন, এমন সামর্থ্যও নেই তার। স্ত্রীসহ দুজনের বয়স্ক ভাতাসহ মাত্র ২০ শতক জমির ফসল উৎপাদনই তার জীবন-জীবিকা নির্বাহের আয়ের উৎস। এ দিয়ে অর্ধাহারে অনাহারে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে তার ৪ সদস্যের পরিবারকে। শেষ বয়সে জীবনযুদ্ধে পরাজীত হয়ে হাফিজার রহমান চিকিৎসার অভাবে গৃহবন্দী অবস্থায় দিন-রাত কাটাচ্ছে বিছানায় শুয়ে।
এসব তথ্য নিশ্চিত করে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক হাফিজার রহমান বার্তা২৪.কম-কে জানান, বিনা বেতনে ৩৩ বছর চাকরি জীবনে সর্বশান্ত হয়েছি। এখন জীবনে নেমে এসেছে অন্ধকার। তুহিন আল জাবির নামে আমার মেজো ছেলে মাস্টার্সে অধ্যায়নরত। এই ছেলেটির জন্য সরকার যদি চাকরির ব্যবস্থা করতেন, তাহলে হয়তো মরার আগে কিছুটা সুখ পেতাম।
নামপ্রকাশ না করা শর্তে অন্য এক স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার সভাপতি বলেন, শুধু হাফিজার রহমানই নয়, তার মতো শত শত শিক্ষক বিনা বেতনে অবসর নেওয়াসহ চাকরি ছেড়ে কর্মের সন্ধানে চলে গেছেন অন্যত্র।
দুর্গাপুর কাদেরিয়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার প্রধান শিক্ষক মোসলেম আলী বার্তা২৪.কম-কে জানান, হাফিজার রহমান প্রতিবন্ধী হলেও পাঠদানে কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু বিধি অনুযায়ী অবসরে গেছেন তিনি। তবে এখন পর্যন্ত মাদরাসাটি এমপিওভুক্ত না হওয়ায় অন্যান্য শিক্ষকরাও চরম হতাশায় ভুগছে।
সাদুল্লাপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার সৈয়দ মনিরুল হাসান বার্তা২৪.কম-কে বলেন, এ উপজেলায় স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা সংখ্যা ৭১টি। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৩ শতাধিক শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছে। তবে সবগুলো মাদরাসা নন-এমপিও হিসেবে রয়েছে।