‘একান বাঁধ করি দিলে হামরা বাঁচমো বাহে’
বয়সের ভারে নুয়ে পড়া ছয়মুদ্দিনের চোখে এখনো ভাসে তার আবাদি জমির ক্ষেত। কোথাও পানি, কোথাও চর জেগে উঠলেও ভুট্টার ক্ষেত আর দেখতে পায় না আশি বছরের এই বৃদ্ধ। এবারের বন্যায় শংকরদহের এক নম্বর ওয়ার্ড বিলীন হবার সঙ্গে সঙ্গে ধুয়ে মুছে নিয়ে গেছে তার আবাদি জমিও। এখন বন্যার ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন ছয়মুদ্দিন। কিন্তু তার এলাকায় নদী রক্ষায় বেড়িবাঁধ না থাকায় শঙ্কা কাটেনি। বরং এই শুকনো মৌসুমেও তার মনে নদী ভাঙনের ভয় তাড়া করছে।
বৃহস্পতিবার (২৯ অক্টোবর) সকালে তিস্তা নদী বেষ্টিত রংপুরের গঙ্গাচড়ার ৫নং লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের বাগেরহাট এলাকায় নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত ছয়মুদ্দিনের সাথে বার্তা২৪.কম-এর কথা হয়। তার বর্ণনায় এবারের বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে শংকরদহ, বিনবিনারচর, পশ্চিম ইচলী ও পূর্ব ইচলীসহ বেশি কিছু গ্রাম। বন্যায় দীর্ঘদিনের চেনা পথঘাট, দোকানপাট ও আবাদি জমির ক্ষেত সবই বিলীন হয়েছে, শুধু বাঁধ না থাকায়।
চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনের স্মৃতি বিজড়িত এখানকার পশ্চিম ইচলী গ্রামে যাবার সময় বাঁশের তৈরি সাঁকোয় দাঁড়িয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কৃষক আজবর আলী বলেন, ‘আসল জাগাত পানি নাই, নদী এ্যলা হামার এত্তি। তিস্তা শুকি খা খা করেছে। আর হামার শংকরদহ, ইচলীত বন্যার পানি এ্যালাও আছে। বাঁধ না থাকাতে বানের পানি উচলি নদী এদি দিয়ে গেইচে। হাজার হাজার মাইনসের ক্ষতি হইচে। ঘরবাড়ি, আবাদি জমি, আস্তাঘাট সোগে নদীত বিলীন। তিস্তা হামাক শ্যাষ করিছে। একান বাঁধ করি দিলে হামরা বাঁচমো বাহে। নাইলে শংকরদহ গোটালে নদী হয়্যা যাইবে।’
যেখানে এক সময় ফসল ফলিয়েছে, সেই আবাদি জমির বুকে এখন ভাসছে নৌকা। অসহায় ইব্রাহিম মিয়া নৌকায় করে বাড়ি ফেরার পথে বার্তা২৪.কম-কে জানান, ‘শংকরদহের এক নম্বর ওয়ার্ড বিলীন হওয়ার পর এখন হুমকিতে রয়েছে দুই ও তিন নম্বর ওয়ার্ড। শুধু তাই নয়, শুকনো মৌসুমেও নয়া তিস্তায় পানির প্রবাহ না কমায় হাজার হাজার ফসলি জমি, ভিটেমাটি এখনো নদীর পেটেই আছে। কোথাও কোথাও পানি কমে জেগে উঠেছে বন্যায় ক্ষত-বিক্ষত রাস্তাঘাট,
ব্রিজ, কালভার্টসহ ঘরবাড়িবিহীন ধুধু চর।’
বন্যায় নদী ভাঙনের শিকার মধ্য ইচলির রমজান আলী, রেহেনা খাতুন, পশ্চিম ইচলির বিপ্লব মিয়াও একই কথা বলেছেন। অনেক আক্ষেপ নিয়ে তিস্তাপাড়ের এসব মানুষ জানান, ‘একটা বেড়িবাঁধ হলে তারাও বাঁচবে, বাঁচানো যাবে শেখ হাসিনা তিস্তা সড়ক সেতুটিও। নইলে মানচিত্র থেকে শংকরদহের সাথে হারিয়ে যাবে অনেক কিছুই।’
এবছর গঙ্গাচড়ায় পাঁচ দফায় বন্যা দেখেছে তিস্তাপাড়ের মানুষ। ভয়াবহ অভিজ্ঞতাও হয়েছে। বন্যার পানিতে অশান্ত হয়ে উঠা সেই তিস্তার বুক এখন শুকিয়ে গেছে। পানি শূন্যতায় জেগে উঠেছে ধুধু বালুচর। শেখ হাসিনা তিস্তা সড়ক সেতুর নীচে শুকনো চরে চলছে ফসল ফলানোর প্রস্তুতি। অথচ চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনের স্মৃতি বিজড়িত এখানকার শংকরদহ, পশ্চিম ইচলী ও পূর্ব ইচলী গ্রাম দিয়ে এখনো বহমান রয়েছে বন্যার পানি। হঠাৎ মূল তিস্তার গতির পথ পরিবর্তন হয়ে বয়ে যাওয়া স্রোতে তিস্তা ঢুকে পড়েছে শংকরদহ ও ইচলীর দিকে।
এখন শুকনো মৌসুমে নদী রক্ষা ও ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে চায় তিস্তাপাড়ের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা। তারা বলছেন, বন্যার সময় বাঁধ না থাকা এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের খামখেয়ালিতে শংকরদহের একটি ওয়ার্ড বিলীন হয়েছে। চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনের নামে প্রতিষ্ঠিত চরের বাতিঘর স্কুলটির কাছাকাছি নদী এসে পৌঁছেছে। বন্যায় পশ্চিম ইচলী, কাশিয়াবাড়ি, বাগেরহাট, বাগদোহারার সহস্রাধিক বাড়িঘর, জমিজমাসহ বিভিন্ন স্থাপনা বিলীন হয়েছে। শুধু তাই নয়, হাজার হাজার আমনের উঠতি ক্ষেত তলিয়ে গেছে নয়া তিস্তায়।
সরকারের কাছে নদী শাসনের জন্য টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা গ্রহণের পাশাপাশি গঙ্গাচড়ার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষায় এখানে সাত কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি স্থানীয়দের।
এনিয়ে শংকরদহ ওয়ার্ডের ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মোন্নাফ আলী জানান, ‘শংকরদহ, জয়রামওঝা, ঈশরকুল, পূর্ব ইচলী, পশ্চিম ইচলী গ্রামের ২০ হাজার মানুষের দুর্দশার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তরাঞ্চলীয় প্রধান প্রকৌশলী দায়ী। শেখ হাসিনা তিস্তা সেতু যে শুকনায় পড়েছে। সেটিও তার কারণেই। আমরা বারবার বলছি শেখ হাসিনা তিস্তা সেতুর মোকা থেকে হুমায়ুন চেয়ারম্যানের বাঁধ পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার একটি বোল্ডার বাঁধ তৈরি করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।’
এদিকে লক্ষ্মীটারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল হাদি বার্তা২৪.কম-কে অভিযোগ করে বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা উপজেলা প্রশাসনসহ সবখানেই ধরনা দিয়েও এ বিষয়ে মেলেনি কোনো সমাধান। একারণে এখানকার মানুষের জীবন ও জীবিকা রক্ষার দাবি থাকলেও সেই দাবি এখন অন্ধকারে। এলাকার এমপি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রীর ডিও লেটার পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন দপ্তরে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। এখানে ৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ না হলে আগামী বন্যায় শেখ হাসিনা তিস্তা সড়ক সেতুসহ শংকরদহের মতো অনেক গ্রাম বিলীন হয়ে যাবে ।’
এ ব্যাপারে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং নদীরক্ষা-বিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘নদীর চরিত্র বুঝে দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই পরিকল্পনার মাধ্যমে তিস্তার উৎসমূল থেকে শেষ পর্যন্ত একটি ডেল্টা পরিকল্পনায় যেমন নদী শাসন প্রয়োজন। তেমনি এখন শংকরদহ, ইচলীর মতো গ্রাম রক্ষা ও এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা বাঁচাতে একটি বেড়িবাঁধ নির্মাণেরও প্রয়োজন রয়েছে।