হতদরিদ্রের ত্রাণের টাকা ইউপি চেয়ারম্যানের পকেটে!
কক্সবাজারের রামুতে ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) দেয়া এক হাজার দরিদ্র জনসাধারণের ত্রাণের প্রায় ১০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযুক্ত মো. ইউনুচ ভূট্টো রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। তিনি ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবকলীগের সভাপতির দায়িত্বে আছেন।
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, চেয়ারম্যানের নির্দেশে ত্রাণের টাকা থেকে মাথাপিছু এক হাজার টাকা করে নেন তার সাঙ্গপাঙ্গরা। বিষয়টি নিয়ে পুরো ইউনিয়নজুড়ে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে প্রতিবাদ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। ত্রাণের টাকা লুটের এ ঘটনায় সরকারের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে জানান সরকার দলীয় নেতাকর্মীরা।
জানা গেছে, গত ২৩ নভেম্বর বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) ত্রাণ সহায়তার ৩য় দফায় ইউনিয়নের এক হাজার পরিবারকে ৪ হাজার টাকা করে প্রদান করা হয়। এ টাকা বিতরণে পরিষদের মেম্বারদের সাথে সমন্বয় করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। উল্টো মেম্বারদের গুরুত্ব না দিয়ে চেয়ারম্যান নিজের খেয়াল খুশি মতো উপকারভোগীদের তালিকা তৈরি করে নিজেই বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেন।
উপকারভোগীদের কেউ কেউ ৪ হাজার টাকার মধ্যে ১ হাজার টাকা করে চেয়ারম্যান ও তার লোকজন নিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন। তারা হলেন-দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের ফকিরামুরা এলাকার নজির আহমদের ছেলে শামসুল আলম, ৭ নং ওয়ার্ডের উজির আলী ছেলে ছৈয়দ করিম, ৫ নং ওয়ার্ডের আবদুস ছোবহানের ছেলে কলিম উল্লাহ, পানেরছড়া এলাকার জহুরা খাতুন, নুরুচ্ছাফা, আমান উল্লাহ, লেদু মিয়া ও জাহাঙ্গীর আলম, কাইম্যারঘোনা এলাকার দিলোয়ারা বেগম, ফাতেমা বেগম, ছায়েরা খাতুন, ৯ নং ওয়ার্ডের মোস্তাফিজের স্ত্রী রেজিয়া, কাইম্যার ঘোনা এলাকার আজিজুল হকের স্ত্রী আনোয়ারা, ৭ নং ওয়ার্ডের ফকিরামুরা এলাকার মৃত ইছহাকের ছেলে জাহাঙ্গীর আলম।
তারা জানান, তাদের মতো অসহায় মানুষ আর নেই। কিন্তু সাহায্যের নামে তাদের দেয়া অর্থ চেয়ারম্যান ইউনুচ ভুট্টো ও তার সহযোগীরা ছিনিয়ে নিয়েছে। সহায়তার নামে এমন লুটপাট তারা আর কখনো দেখেননি।
তারা আরো জানান, তাদের অধিকাংশ উপকারভোগীর কাছ থেকে টোকেন নেয়ার সময় চেয়ারম্যান ও তার সহযোগীরা এক হাজার টাকা করে নিয়ে গেছে। আর যাদের টাকা ছিলো না, তাদের সোমবার পরিষদে টাকা দেয়ার পরে নিয়েছেন। পরিষদের ভিতরে টাকা দেয়া হলেও পরিষদের বাইরে চেয়ারম্যানের ঠিক করা লোকজন দাঁড়িয়ে ছিলো। তারাই চেয়ারম্যানের নির্দেশের কথা বলে এক হাজার টাকা করে নেয়। কেউ টাকা দিতে চাইলেও মারধর করা এবং প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপকারভোগীরা।
ভুক্তভোগীরা আরো বলেন, পত্রিকায় নাম আসলে চেয়ারম্যান তাদের উপর মারধর ও হামলা চালাতে পারে। তাই তারা এ বিষয়ে প্রশাসনের হস্তক্ষেপও কামনা করেছেন।
জানা গেছে, রাতে টাকা বিতরণ শেষে ডব্লিউএফপি-ব্র্যাক এর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চলে যাওয়ার পর তাদের কাছ থেকে নেয়া টাকা পরিষদেই ভাগ-বাটোয়ারা করেন ইউপি চেয়ারম্যান ইউনুচ ভুট্টো।
চেয়ারম্যানের সহযোগী হিসেবে কারা ছিলো জানতে চাইলে ভুক্তভোগীদের মুখে অনেকের নাম পাওয়া যায়।
আমান উল্লাহ সওদাগর, চেয়ারম্যানের শ্যালক নুরুল আজিম, চাচাতো ভাই মুন্না, খালাতো ভাই সুলতান, পরিষদের তথ্য সেবা কেন্দ্রে দায়িত্বরত জাহেদ, আবদুল করিম, ১ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা হোছন আহমদ, ২ নং ওয়ার্ডের মাস্টার মনু, মাস্টার রহমত উল্লাহ, আহমদ উল্লাহ, আবু ছৈয়দ, ৩ নং ওয়ার্ডের ইব্রাহিম সওদাগর, পাসপোর্ট অফিসের দালাল হিসেবে পরিচিত আমান উল্লাহ। এছাড়া ১ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য হোছন আহমদ ও ৬ নং ওয়ার্ডের চৌকিদার ছলিম চেয়ারম্যানের এসব অপকর্মে অন্যতম সহযোগী হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন বলেও জানান ভুক্তভোগীরা।
এ ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ক্ষোভ প্রকাশ করে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের বাসিন্দা সুপ্রিম কোর্টেরর আইনজীবী সাদ আল আলম চৌধুরী। এতে তিনি লিখেছেন ‘দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নে দুর্নীতির মহোৎসব চলছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) সহায়তাধীন, উপজেলা প্রশাসন রামু ও জেলা প্রশাসন কক্সবাজার এর সার্বিক সহযোগিতায় ৮ নং দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের উপরকাভোগী পরিবারের মাঝে নগদ প্রতি ৪ হাজার টাকা করে দেয়ার কথা ছিলো। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের ও পরিতাপের বিষয় ৪ হাজার টাকা নগদ সহায়তা পাওয়ার জন্য ১ হাজার টাকা করে ঘুষ দিতে হয়েছে। যা ইউনিয়নের লোক মুখে এখন বহুল আলোচিত। ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ও তার দলবলের এ ধরনের ঘৃণ্য অপরাধ ও অভিযোগের শেষ নেই। বর্তমান চেয়ারম্যান দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের জনগণের সম্পদ হরিলুট করে নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত।
দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের মেম্বার মোজাহের আহমদ জানিয়েছেন, এসব ত্রাণ বরাদ্দে মেম্বারদের সম্পৃক্ত করা হয়নি। চেয়ারম্যান উল্টো মেম্বাদের বলেছেন, এসব বরাদ্দ সরকারি নয়, এনজিও’র দেয়া। তাই এসব ত্রাণ তিনি নিজের ইচ্ছে মতো বিতরণ করবেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) সহকারি প্রকল্প কর্মকর্তা সোহানুর রহমান আসিফ জানান, দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নে এক হাজার পরিবারকে ৪ হাজার টাকা করে গত সোমবার (২৩ নভেম্বর) বিতরণ করা হয়েছে। চেয়ারম্যান নিজেই তালিকা তৈরিসহ যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন। উপকারভোগীদের কাছ থেকে ১ হাজার টাকা করে নেয়ার বিষয়টি সুষ্ঠু তদন্ত করা হবে। প্রমাণ পেলে টাকা ফেরত দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হবে।
তিনি আরো বলেন, এখনো করোনার প্রভাব চলছে। এভাবে অনিয়ম হয়ে থাকলে ভবিষ্যতে এ ইউনিয়নে ডব্লিউএফপির ত্রাণ সহায়তা বন্ধ করে দেয়া হতে পারে।
রামু উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রণয় চাকমা জানিয়েছেন, টাকা বিতরণের শুরুতে অনিয়মের কথা শুনেছি। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) কর্মকর্তারাও এ নিয়ে আমার কাছে এসেছিলো। তারা বলেছে, পরবর্তীতে তারা এটা বন্ধ করে দিয়েছে। ইউএনও আরো বলেন, সুষ্ঠু তদন্ত করা হবে। অনিয়মের প্রমাণ পেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ ব্যাপারে বক্তব্য নেওয়ার জন্য দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউপি চেয়ারম্যান মো. ইউনুচ ভুট্টোর ফোনে শনিবার (২৮ নভেম্বর) রাত পৌনে ৯ টার দিকে একাধিকবার কল করা হয়। কিন্তু তিনি কল রিসিভ করেননি।