একই পরিবারের চার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা, তদন্তে দুদক
পাওনা পরিশোধ না করা এবং অবৈধভাবে বিপুল পরিমান সম্পদ অর্জনের অভিযোগে একই পরিবারে চার পুলিশ সদস্যসহ ছয় জনের বিরুদ্ধে রংপুর স্পেশাল জজ আদালতে মামলা হয়েছে। পরে আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে দুর্নীতি দমক কমিশনকে (দুদক) তদন্তের ভার দিয়েছেন। মামলাটি করেছেন লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী স্থলবন্দরের আমদানি ও রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স তুহিন এন্টার প্রাইজের সত্ত্বাধিকারী ব্যবসায়ী তারিকুজ্জামান।
এ বিষয়ে রংপুর জজ কোর্টের অ্যাডভোকেট অর্পিতা বসু রায় বলেন, ‘আসামিরা পুলিশি ক্ষমতা দেখিয়ে অবৈধ সম্পদ গড়েছেন। তাই দুদক ও মানি লন্ডারিং আইনে বাদির দায়ের করা অভিযোগটি আমলে নিয়ে দুদককে তদন্তের ভার দিয়েছেন আদালত। আগামী ২৮ জানুয়ারির মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
যাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে তারা হলেন- রংপুরের মাহিগঞ্জ পুর্বখাসবাগ এলাকার অবসর প্রাপ্ত পুলিশ সদস্য নুর ইসলাম এবং তার চার ছেলে ও পুত্রবধু। ছেলেদের মধ্যে ঢাকা এপিবিএনের উপ-পুলিশ পরিদর্শক (এসআই) মনিরুজ্জামান সুমন (পুলিশ আইডি নং- ৮৬১৩১৪৭৯৮৮), শিল্পাঞ্চলের সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) রোকনুজ্জামান (পুলিশ নং-৮৭০৬০৯৯৪৯), কুড়িগ্রাম আদালত পুলিশের সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) মফিকুজ্জামান (পুলিশ নং- ৮৩০৩০৮৩১৭৮), হাসানুজ্জামান এবং পুত্রবধূ কাজলি বেগম।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, নিজেকে ঢাকার এপিবিএনের এসআই পরিচয় দিয়ে মনিরুজ্জামান সুমন বুড়িমারী স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী তারিকুজ্জামান তুহিনের কাছ থেকে বাকিতে ১৮ লাখ ৯২ হাজার ৪৫৫ টাকার পাথর ক্রয় করেন। সেই পাওনা টাকা চাওয়ায় ফোনে ব্যবসায়ীকে হুমকি দেন এবং স্ত্রী ও বোনকে দিয়ে একাধিক মিথ্যা মামলা করান। যা আদালতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৩ সালে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য নুর ইসলাম রংপুর সাতমাতা পুর্বখাসবাগে ১২ শতাংশ জমির উপর ১০ তলা ভিত্তির বাড়ি নির্মাণ করেন। তার ছেলে এপিবিএনের এসআই মনিরুজ্জামান ২০১৪ সালে পুলিশে যোগ দিয়ে ৬ বছরেই ঢাকার বাড্ডায় সাড়ে ১৬ শতাংশ জমিতে নির্মিত বাড়ির ৪০ লাখ টাকার শেয়ারের মালিক, রাজধানীর সবুজবাগে সে ও তার স্ত্রী কাজলির নামে ৯৬ লাখ টাকায় কেনা ৮ শতাংশ জমির উপর ১০ তলা ভবন নির্মাণাধীন, সে ও তার ভাই এএসআই রোকনুজ্জান, হাসানুজ্জামান ও দুইজন পার্টনারসহ যৌথ নামে ঢাকার দক্ষিণ কাজি বাড়ি মোড়ে ৫ কাঠা জমির উপর ১০ তলা ভবন নির্মাণাধীন, আফতাব নগরে দেড় কোটি টাকা মূল্যের ৫ কাঠা জমির গ্রিন সুরভী কনস্ট্রাকশনের ব্যবসার অর্ধেক শেয়ারের মালিক, তার ছেলে আল ওয়াফির নামানুসারে আল ওয়াফি প্রোপার্টিজ লি. নামে রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠানও গড়েছেন।
এছাড়াও এসআই মনিরুজ্জামান সুমন ঢাকা খিলগাঁও ত্রিমোহনী এলাকায় আড়াই কাঠা, বনশ্রী লিংক রোডে ৩ কাঠা জমির মালিক, আফতাব নগরের মেরুল বাড্ডায় ১২ কাঠা জমির উপর ১৪ তলা ড্রিম ভ্যালির ফ্ল্যাট বিক্রির বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন, বনশ্রী টেকেরপাড় চৌরাস্তা মোড়ে ৩ কাঠায় ৭ তলা ভবন, একই এলাকার জে ব্লোকে ১০ কাঠা, পাশে ৩ কাঠা ও আফতাব নগর আবাসিক এলাকার সাড়ে ৫ কাঠা, বসুন্ধরা এল ব্লকে ৫ কাঠা জমিতে নির্মাণাধীন ভবনের ফ্ল্যাট বিক্রির বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন। বনশ্রী ব্লক জে'তে গ্রিন প্লাজা ও আফতাবনগরের এল ব্লকে ড্রিমটাচ টাওয়ার নামে বহুতল ভবন নির্মাণও শুরু করেছেন তিনি।
এসআই মনিরুজ্জামান ২০১৬ সালে রংপুরের পীরগাছার কাজলি বেগমকে বিয়ে করে অবৈধ সম্পদ বৈধ করতে স্ত্রীর নামে হস্তান্তরের চেষ্টা করছেন।
এএসআই রোকনুজ্জামান ২০০৭ সালে পুলিশে যোগ দিয়ে ১৭ সালে পদোন্নতি পান। এরপর তিনিও আঙ্গুল ফুলে বলাগাছ বনে যান। তিনিও ঢাকার জিয়া সরণী রোড়ে ৯০ লাখ টাকায় একটি ফ্লাট ক্রয় করে ভাড়া দিয়েছেন। তার নামে বাড্ডা রোড়ে কফি এক্সপ্রেস নামের ৪৫ লাখ টাকার দোকান, দক্ষিণ বনশ্রী ফাউন্ডেশন ড্রিম ক্যাসটেল প্রজেক্টের এল ব্লকে ৮৬ লাখ টাকায় ডাবল ফ্ল্যাট ক্রয় করেছেন তিনি। তিনি দুটি পাসপোর্ট ব্যবহার করেন। তিনি প্রায়ই বিভিন্ন দেশে ব্যক্তিগত কাজে ভ্রমণ করেন।
অন্যদিকে, এএসআই মফিকুজ্জামানও ক্ষমতায় ভয় ভিতি দেখিয়ে ৭৪ লাখ টাকা মূল্যে রংপুরের কামালকাছনায় ১৪ শতাংশ জমিসহ আধপাকা ঘর ক্রয় করেন। অপর ভাই হাসানুজ্জামান চট্টগ্রামে জাহাজে চাকরি করলেও নিজেকে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করে এবং পুলিশ সদস্য ভাইদের প্রভাবে মাদক ব্যবসায় করেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়াও এই পুলিশ পরিবার তাদের আত্নীয় স্বজনদের মাধ্যমে ইটভাটা, চালের আড়ত, মুদির দোকান পরিচালনা করেন এবং নিজ এলাকায় ও ভাইদের শ্বশুর বাড়িতে রয়েছে বিপুল পরিমাণ ফসলি জমি। পুলিশে চাকরির প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ পথে অর্থ আদায় করে ২০১৪ সালে হঠাৎ করে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয় পরিবারটি। তাদের এসব অবৈধ সম্পদের তদন্ত করে ও মানি লন্ডারিং আইনে ব্যবস্থা নিতে গত ১২ ডিসেম্বর রংপুর স্পেশাল জজ আদালতে মামলা দায়ে করেন ব্যবসায়ী তারিকুজ্জামান তুহিন।
অভিযুক্ত এসআই মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আমার স্ত্রী তার বান্ধবীর সাথে যৌথ ব্যবসা করে সম্পদ করেছেন। স্ত্রীর ব্যবসায় তো বাঁধা নেই। আমার মাত্র একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। পুলিশের অনেকেই অনেক কিছু করেছেন। পাথরের কিছু টাকা বকেয়া থাকায় ব্যবসায়ী তুহিন মামলা করেছেন। আমি সেটা আইনিভাবে মোকাবিলা করবো।’
কুড়িগ্রাম আদালত পুলিশের এএসআই মফিকুজ্জামান বলেন, ‘ব্যবসায়ী দ্বন্দ্ব থাকলে ভাইয়ের সাথে ছিল। সেই বিরোধে আমার বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ বিভাগে আমাকে হেয় করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমি ওই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করবো।’
তবে তার কোনও অবৈধ সম্পদ নেই বলেও দাবি করেন মফিকুজ্জামান।