প্রাথমিকের গন্ডি না পেরোনো জয়নাল গড়ে তুলেছেন পাঠাগার
পেশায় মৌসুম ভিত্তিক ক্ষুদ্র ধান ব্যবসায়ী। ধানের মৌসুম ছাড়া বাকি সময় দিনমজুরের কাজ করে চলে সংসার। পারিবারিক অভাব অনটনে প্রাথমিকের গন্ডিও পার হতে পারেননি। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অপূর্ণতার হতাশা তাকে শিক্ষা থেকে দূরে রাখতে পারেনি। নিজেকে স্বশিক্ষিত হিসেবে গড়ে তুলে উদ্যোগ নেন নিজ এলাকায় পাঠাগার গড়ে তোলার। অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে আজ সফলতার আলো ফুটেছে তার ‘সাতভিটা গ্রন্থনীড়’ নামক পাঠাগারের।
গল্পটি কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বুড়া-বুড়ি ইউনিয়নের সাতভিটা গ্রামের মৃত কাশেম আলীর ছেলে জয়নালের (৩২)। বইয়ের প্রতি ভালোবাসা এবং বই পাঠের মাধ্যমে উচ্চতর হৃদয়বৃত্তিক চার্চার উদ্দেশ্যেই এই উদ্যোগ বলে জানালেন তিনি।
উদ্যোগতা জয়নাল আলী জানালেন, মৌসুম ভিত্তিক ক্ষুদ্র পরিসরে ধানের ব্যবসা এবং বাকি সময় দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালানোর পাশাপাশি কিছু অর্থ জমাতে শুরু করেন তিনি। ২০১৫ সালের দিকে প্রায় ১০০ বই নিয়ে নিজ বাড়িতে গড়ে তোলেন পাঠাগার। গ্রাম অঞ্চলে পাঠক যোগার করতে ছুটতে হয়েছিল শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি। প্রয়োজনে শিক্ষার্থীদের বাড়ি গিয়ে বই সরবরাহ করতে হতো বলেও জানান তিনি।
সাতভিটা গ্রন্থনীড় পাঠাগারটির অবস্থান কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বুড়া-বুড়ি ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের সাতভিটা নামক একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। জেলা শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার এবং উপজেলা শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটারের দূরত্ব হওয়ায় আধুনিকতার ছোঁয়া গ্রামটিতে এখনো পৌঁছায়নি। সেরকম একটি অঞ্চলে পাঠাগারের উদ্যোগ নেওয়ায় প্রসংশা কুড়াচ্ছেন জয়নাল আলী।
ধীরে ধীরে পাঠক সংখ্যা বৃদ্ধি হলে ২০১৯ সালে নিজ অর্থায়নে ১ শতক জমি কিনে সেখানে টিনের ঘর নির্মাণের পরিকল্পনা করেন তিনি। সেই পরিকল্পনা অর্থনৈতিক বাস্তবতায় ধীরে ধীরে এগুতে থাকলেও আজ সেটি বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে। তার এই সাফল্যে খুশি এলাকাবাসী।
এব্যাপারে জয়নাল বলেন, পাঠকের চাহিদা পূরণ করতে বাড়ি থেকে আলাদা যায়গায় নেওয়ার কথা ভাবি। এরপর ১ শতাংশ জমি কিনে একটি টিনের ঘরসহ আসবাবপত্র তৈরিতে প্রায় ৮০ হাজার টাকা খরচ হয় যা সম্পূর্ণ আমার নিজের উপার্জনের টাকা। আজ আমি খুবই খুশি। প্রায় দেড়শো জন পাঠকেকে বই দিতে পেরেছি। ১০টি করে বই পড়া পাঠকের সংখ্যা ১০০ এর বেশি। বর্তমানে ৫ শতাধিক বই দিয়েও পাঠকের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না বলেও জানান তিনি।
রোববার (২৮ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে পাঠাগারের নতুন ভবন শুভ উদ্বোধন ও সেরা পাঠক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান উপলক্ষে জয়নালের উদ্যোগের পাশে দাঁড়াতে জেলা শহর থেকে ছুটে যান শিক্ষক, লাইব্রেরিয়ান, সাংবাদিক ও সমাজকর্মীরা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বইয়ের প্রতি ভালোবাসার এই উদ্যোগের ভূয়সী প্রসংশার পাশাপাশি সার্বক্ষণিক পাশে থাকারও প্রতিশ্রুতি দেন তারা।
পাঠাগার পরিদর্শনে আসা বই বিশ্লেষক আখতারুল ইসলাম রাজু বলেন, আমি অত্যন্ত আনন্দিত। প্রত্যন্ত এলাকায় এরকম একটা পাঠাগার হচ্ছে। আমাদের বই পড়ার আন্দোলন এক ধাপ এগিয়ে গেলো। সমাজকর্মী সুব্রতা রায় বলন, লাইব্রেরিগুলো গ্রামেই হওয়া উচিত। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে পড়াশোনা খুবই জরুরি। শিক্ষক ও সাংবাদিক আব্দুল ওয়াহেদ বলেন, ইন্টারনেট ভিত্তিক পড়াশোনার থেকে পুস্তকভিত্তিক পড়াশোনার গুরুত্ব বেশি যা এই পাঠাগারে সম্ভব।
প্রভাষক আবু হেনা মোস্তফা বলেন, পাঠক পাঠাগারের প্রাণ। পাঠকের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারাটাই মূল চ্যালেঞ্জ। প্রতিষ্ঠাতা জয়নাল বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাঠক সংগ্রহ করছে যা এই উদ্যোগকে সফল করবে বলেও তিনি মনে করেন। কুড়িগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যাপক সুশান্ত বর্মন বলেন, আমাদের সব ধরনের আগ্রহ থাকবে এই পাঠাগারটিকে সমৃদ্ধ করার জন্য। কুড়িগ্রাম গণগ্রন্থাগারের লাইব্রেরিয়ান কে এম মেহেদী হাসান বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই লাইব্রেরিটি নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। আমি বিশ্বাস করি এটি যুগযুগ ধরে আলো ছাড়াবে।
সাতভিটা বিশেষ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থী আম্বিয়া আক্তার মিম বলেন, আমরা স্কুলের বই পড়ার পাশাপাশি অনেক ধরনের বই পড়তে পারছি। জয়নাল ভাই আমাদের বাড়ি থেকে ডেকে এনে বই পড়ান। ২য় শ্রেণির শিক্ষার্থী রাকিবুল হাসান রাব্বি জানালেন, আমরা এখানে এখন বই পড়তে পেরে অনেক খুশি। এতদিন আমাদের নিজ বাড়িতে বই পড়তাম। কিন্তু এখন আমরা সবাই একসাথে বই পড়তে পারবো।
স্থানীয় যুবক পলাশ চন্দ্র সরকার বলেন, প্রায় চার মাস থেকে আমি এই পাঠাগারের সাথে সম্পৃক্ত। আমরা ভীষণ গর্বিত যে জয়নাল ভাইয়ের মত যুবক আমাদের গ্রামে আছে। বুড়া-বুড়ি ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম ফুলু বলেন, আমি মনে করি জয়নালের মত সাধারণ মানুষের এই উদ্যোগের কারণে সমাজ দ্রুত এগিয়ে যাবে। সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখার পাশাপাশি পাঠাগারে বই উপহার দেওয়ার কথাও জানান তিনি।
পাঠাগারে বই সরবরাহ সহ বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতার মাধ্যমে পাঠাগারটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন উদ্যোক্তাতা জয়নাল আলী।