ঝুড়ির সেমাই নিয়ে প্রশ্ন
ঈদের আগে বেড়ে যায় সেমাইয়ের চাহিদা। বাজারের সেই চাহিদা মেটাতে রাজশাহীর কারখানাগুলোতে উৎপাদনও বেড়ে যায়। পুরনো বেকারি কারখানার পাশাপাশি মৌসুমি কিছু ব্যবসায়ীও শুধু ঈদের আগেই সেমাই তৈরি করে থাকেন। এবার ঈদ-উল-ফিতরের আগেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দিনরাত এক করে শ্রমিকেরা লাচ্ছা ও খিল সেমাই তৈরি করেছেন। উৎপাদিত সেমাই নগরীর বিভিন্ন বাজারে পাঠানো হয়েছে। প্যাকেটের বদলে বেশিরভাগ সেমাই পাঠানো হয়েছে ঝুড়িতে করে। এই ঝুড়িতে সেমাইয়ের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি), ওজন, উৎপাদন এবং মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ থাকে না। কোন প্রতিষ্ঠান এই সেমাই উৎপাদন করেছে তাও কোথাও লেখা নেই।
রাষ্ট্রায়াত্ব মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) রাজশাহীর পরিচালক প্রকৌশলী সেলিম রেজা বলেন, ‘যাঁরা আমাদের লাইসেন্স নেয়ার পর সেমাই উৎপাদন করছে তাঁদের অবশ্যই পণ্যের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য, উৎপাদন ও মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ লিখতে হবে। সেমাইয়ের ক্ষেত্রে যদি প্যাকেটের মোড়ক না ব্যবহার করে ঝুড়ি ব্যবহার হয় সেক্ষেত্রেও দিতে হবে। এসব তথ্য না দিলে লাইসেন্সের শর্ত লঙ্ঘন হবে।’
রাজশাহী মহানগরীর সাহেব বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, মুদি দোকানগুলোতে প্যাকেটজাত সেমাইয়ের পাশাপাশি ঝুড়িতে করেও সেমাই বিক্রি হচ্ছে। কয়েকটি দোকান ঘুরে কোথাও ঝুড়িতে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য, উৎপাদন ও মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ এবং উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা দেখা যায়নি। ফলে এসব সেমাই কারা উৎপাদন করেছে তা জানা যায়নি।
সাহেব বাজার এলাকার মুদি দোকানী সাইদুর রহমান বলেন, ‘আমরা বিসিকের কারখানা থেকে এসব সেমাই আনি। কারাখানার লোকেরা জানিয়েছে, প্রতিটি ঝুড়িতে ৭৪ কেজি সেমাই আছে। আমরা সেভাবেই বিক্রি করছি।’ ওজন, তারিখ, খুচরা মূল্য লেখা না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এগুলো যুগ যুগ ধরে এভাবেই বিক্রি হয়। ওজনে কম থাকলে তো আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবো। ওজনে কম থাকে না। তবে উৎপাদন-মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখটা থাকলে ভাল হয়।
রাজশাহী মহানগরীর সপুরায় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) এলাকার কয়েকটি কারখানা ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ স্থানেই ঝুড়িতে সেমাই বাজারজাত করা হচ্ছে। তবে রাজশাহীর পুরনো কয়েকটি বড় বড় বেকারিতে প্যাকেটজাত সেমাই উৎপাদন করা হচ্ছে। কয়েকটি কারখানায় আবার একেবারেই নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সেমাই তৈরি করতে দেখা গেছে।
বিসিক এলাকার এডিআই ফুডস কারখানার গুদাম থেকে সেমাই বের করা হচ্ছিল। শ্রমিকেরা ঝুড়িভর্তি সেমাই তুলছিলেন ভ্যানে। কারখানাটির গুদামে গিয়ে দেখা যায়, সারি সারি সেমাইয়ের ঝুড়ি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। তবে কারখানার সামনে এর অফিসে প্যাকেটজাত সেমাই রাখা হয়েছে। কিন্তু কারখানার গুদামে একটিও সেমাইয়ের প্যাকেট দেখা যায়নি।
কারখানার মালিক আবদুল আজিজ না থাকায় তাঁর সঙ্গে কথা বলা যায়নি। কারখানার কর্মীরা বলেছেন, ঝুড়িতে সেমাই দিলে খরচ কম হয়। কম সময়ের মধ্যে বাজারজাতও করা যায়। তাই ঈদের সময় ঝুড়িই ব্যবহার করা হয়। তবে বছরের অন্যান্য সময় প্যাকেটজাত সেমাই উৎপাদন হয় বলে দাবি তাঁদের। শ্রমিকেরা আরও জানিয়েছেন, এবার সেমাইয়ের চাহিদা গতবছরের চেয়ে কম। গতবছর ঈদে তাঁরা প্রায় ১০০ ঝুড়ি সেমাই উৎপাদন করেন। এবার হয়েছে ৬০ ঝুড়ি।
বিসিকের রাতুল বেকারি সারাবছর পাউরুটি, কেক ও বিস্কুট-চানাচুর উৎপাদন করে। আর ঈদের সময় উৎপাদন করে সেমাই। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কারখানায় অনেক খালি ঝুড়ি রাখা হয়েছে। এটির মালিক মো. মানিক জানালেন, গত ১৫ দিনে তাঁরা সেমাই উৎপাদন করে ঝুড়িতে করেই বাজারে পাঠিয়েছেন। এবার উৎপাদন খরচের চেয়ে সেমাইয়ের কেজিপ্রতি পাইকারি মূল্য বেশি হওয়ার কারণে এখন উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছেন। তাঁরা এই ঝুড়িতে করেই সেমাই বাজারজাত করেন। এতে কোন তথ্য লেখা থাকে না স্বীকার করে মানিক বলেন, ‘না থাকলেও তেমন সমস্যা নাই। কারণ, ঈদের মধ্যেই এসব সেমাই বিক্রি হয়ে যায়। পড়ে থাকে না।’
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) রাজশাহী জেলার সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা মামুন বলেন, ‘বিসিকে গুটিকয়েক কারখানার সেমাই তৈরির অনুমোদন আছে। কিন্তু এখন বিসিক শিল্প এলাকার বাইরেও শহরের আনাচে-কানাচে অনেকে বাসাবাড়িতে সেমাই তৈরি হয়। মূলত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অনুমোদনহীন যেসব সেমাই তৈরি হয়, সেগুলোই প্যাকেটজাত করা হয় না। খোলাভাবে এসব সেমাই ঝুড়িতে বিক্রি করা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘সেমাইয়ের মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ কত, কবে তৈরি হয়েছে তার কিছুই ঝুড়িতে লেখা থাকে না। সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য না থাকায় ঈদের আগে দোকানীরাও ইচ্ছেমতো দাম আদায় করেন। ভোক্তারা প্রতারিত হন। আবার এসব সেমাই খেয়ে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে কাউকে ধরার মত সুযোগও নেই। কারণ, এগুলো কে উৎপাদন করেছেন সেটাও ঝুড়িতে লেখা থাকে না। তাই ঝুড়িতে সেমাই বাজারজাত বন্ধ করা উচিত। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন এবং বিএসটিআইও যেন দ্রুত এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করে।’
বিএসটিআইয়ের রাজশাহীর পরিচালক প্রকৌশলী সেলিম রেজা বলেন, অনুমোদিত ভাল কারখানাগুলো ঝুড়িতে সেমাই বাজারজাত করে না। যাঁদের লাইসেন্স নেই, তাঁরা এভাবে ঝুড়িতে নিম্নমানের সেমাই বাজারজাত করে যেন তাঁদের ধরা না যায়। তবে আমরা এসব কারখানা খুঁজি। খুঁজে পেলে অভিযান চালিয়ে উৎপাদন বন্ধ করা হয়। সেমাই ধ্বংস করা হয়।
অনুমোদনহীন লাচ্ছা সেমাই উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গত বৃহস্পতিবারও (৬ মে) যৌথভাবে অভিযান চালিয়েছে রাজশাহী বিএসটিআই ও জেলা প্রশাসন।
অভিযানে লাচ্ছা সেমাইয়ের মোড়কজাত নিবন্ধন সনদ না থাকায় ওজন ও পরিমাপ মানদণ্ড আইন অনুযায়ী বিসিকের মেসার্স ফুড ফেয়ার নামে একটি কারখানাকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট লসমী চাকমা এই জরিমানা করেন। অভিযানে সহযোগিতা করেন রাজশাহী বিএসটিআইয়ের সহকারী পরিচালক জহুরুল ইসলাম ও পরিদর্শক শাহ আলম পলাশ খাঁন এবং ফিল্ড অফিসার সাখাওয়াত হোসেন।