ঐতিহাসিক ৬ দফা বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার রক্ষাকবচ
ঐতিহাসিক ছয় দফা বাঙালি জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতার রক্ষাকবচ। এর মাঝেই বাঙালি জাতি যাবতীয় শোষণ অত্যাচার, নিপিড়ন, বৈষম্য থেকে মুক্তির জয়গান গাওয়ার স্বপ্ন দেখে। বাঙালির সেই স্বপ্ন দ্রষ্টা শেখ মুজিব হয়ে উঠেন বাঙালির অসাংবাদিত নেতা। ভালবাসার স্পন্দনে গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু উপাধি, দেখান স্বাধীনতার স্বপ্ন। কৃষক, শ্রমিক, জনতা তাদের রক্ত দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া বাঙালির এই ম্যাগনা কার্টা। জাতি ফিরে পায় এক নব চেতনা। যেই চেতনায় বাঙালীকে এনে দেয় মুক্তি, এনে দেয় স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষায়:
ছয় দফা বাংলার শ্রমিক–কৃষক, মজুর–মধ্যবিত্ত তথা আপামর মানুষের মুক্তির সনদ, ছয় দফা শোষকের হাত থেকে শোষিতের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ছিনিয়ে আনার হাতিয়ার, ছয় দফা মুসলিম–হিন্দু–খ্রিস্টান–বৌদ্ধদের নিয়ে গঠিত বাঙালি জাতির স্বকীয় মহিমায় আত্মপ্রকাশ আর আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের চাবিকাঠি...। ছয় দফার সংগ্রাম আমাদের জীবন–মরণের সংগ্রাম।
১৯৪৭ সালে দ্বি জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি। এক পাশে পূর্ব পাকিস্তান আর অন্য পাশে পশ্চিম পাকিস্তান মাঝখানে ৪০০ মাইলের ব্যবধান। এই ব্যবধান শুধু দুরত্বের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত এই ১৮ বছর পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের উপর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বাঙালির ন্যয্য অধিকার ও অস্তিত্ব রক্ষার ব্যবধান ছিল। প্রদেশ বা কেন্দ্রে বাঙালি সংখ্যা গরিষ্ঠ হওয়া সত্তেও যেমন অধিকার ভোগ করতে পারে নি তেমনি প্রশাসনেও পায় নি সাংবিধানিক নিয়োগ। বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রায় ৬০ শতাংশ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের। কিন্তু প্রায় সমস্ত অর্থ ব্যয় হতো পশ্চিমাঞ্চলের জন্য। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে আর বৈদেশিক ঋণের বোঝা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের। নানা অযৌক্তিক অজুহাতে সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের নেয়া হতো না।
পাকিস্তানি শাসন, শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে আইয়ুব খান সরকারের বিরুদ্ধে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানের নেতৃত্বে লাহোরে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সব বিরোধী রাজনৈতিক দল নিয়ে এক জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করা হয় ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দিন অনুষ্ঠিত সম্মেলনের সাবজেক্ট কমিটিতে ছয় দফা উত্থাপন করেন। পরের দিন সম্মেলনের আলোচ্যসূচিতে যাতে এটি স্থান পায়, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু এই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর এই দাবির প্রতি আয়োজক পক্ষ গুরুত্ব প্রদান করেননি। তারা এ দাবি প্রত্যাখ্যান করেন।
প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু সম্মেলনে যোগ না দিয়ে লাহোরে অবস্থানকালেই ছয় দফা উত্থাপন করেন। এ নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন খবরের কাগজে বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা বলে চিহ্নিত করা হয়। পরে ঢাকায় ফিরে বঙ্গবন্ধু ১৩ মার্চ ছয় দফা এবং এ ব্যাপারে দলের অন্যান্য বিস্তারিত কর্মসূচি আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদে পাস করিয়ে নেন।এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আঞ্চলিক ভাষায় বলেছিলেন, ‘আরে মিয়া বুঝলা না, দফা তো একটাই। একটু ঘুরাইয়া কইলাম।’
বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা ছিল:
দফা ১: লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেশন বা যুক্তরাষ্ট্র। সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত আইন পরিষদের প্রাধান্যসহ সংসদীয় পদ্ধতির সরকার গঠনের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
দফা ২: বৈদেশিক সম্পর্ক ও প্রতিরক্ষা ছাড়া সকল বিষয় অঙ্গরাষ্ট্র বা প্রদেশের হাতে ন্যস্ত থাকবে। উল্লিখিত দুটি বিষয় ন্যস্ত থাকবে কেন্দ্রীয় বা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের হাতে।
দফা ৩: পাকিস্তানের দুটি অঞ্চলের জন্য পৃথক অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রাব্যবস্থার প্রবর্তন করতে হবে। অথবা সমগ্র দেশে একটি মুদ্রাব্যবস্থা থাকবে, তবে সে ক্ষেত্র পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচার রোধের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য একটি ফেডারেল ব্যাংকের অধীনে কার্যকরী ব্যবস্থা থাকতে হবে।
দফা ৪: অঙ্গরাষ্ট্র বা প্রদেশগুলোর কর বা শুল্ক ধার্য করার ক্ষমতা থাকবে। তবে ব্যয় নির্বাহের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার এর একটি অংশ পাবে।
দফা ৫: পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পৃথক হিসাব রাখা হবে। অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা স্ব স্ব অঞ্চলের বা অঙ্গরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের বৈদেশিক নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আঞ্চলিক সরকার বিদেশে বাণিজ্য প্রতিনিধি প্রেরণ এবং যেকোনো চুক্তি সম্পাদন করতে পারবে।
দফা ৬: নিজস্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অঙ্গরাষ্ট্রসমূহ প্যারামিলিশিয়া বা আধা সামরিক বাহিনী গড়ে তুলতে পারবে।
বঙ্গবন্ধু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, ছয় দফার বাস্তবায়ন ছাড়া বাঙালির জাতির মুক্তি সম্ভব নয়। বাঙালির মানষকোঠায় ছয় দফা জায়গা করে নেয়।শহর,নগর, বন্দর সব জায়গায় ছয় দফার পক্ষে আপোশহীন কন্ঠ বেরিয়ে আসে। ছয় দফা আন্দোলনের সঙ্গে পূর্ব বাংলার সকল স্তরের মানুষ – রিক্সাওয়ালা, স্কুটারওয়ালা, কলকারখানার শ্রমিক, বাস-ট্রাক-বেবিটেক্সি চালক, ভ্যান চালক, দোকানদার, মুটে-মজুর – সকলে এ আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন।
বাঙালির গণজাগরণে তখনকার পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান চিন্তিত ও বিচলিত হয়ে পড়েন। যেকোনো মূল্যে ছয় দফার দাবি দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। এমনকি তিনি অস্ত্রের ভাষায় জবাব দেওয়ার হুমকি দেন। এই ছয় দফা আন্দোলনে প্রথম শহীদ হন সিলেটের মনু মিয়া। এছাড়াও এই দিনে আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে পুলিশ ও ইপিআর টঙ্গী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় গুলি চালায়। শহীদ হন শফিক, শামসুল হক, মুজিবুল হকসহ অনেকে।
শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন. ‘১২টার পরে খবর পাকাপাকি পাওয়া গেল যে হরতাল হয়েছে। জনগণ স্বতস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছেন। তাঁরা ৬-দফা সমর্থন করে আর মুক্তি চায়। বাঁচতে চায়, খেতে চায়, ব্যক্তি স্বাধীনতা চায়, শ্রমিকের ন্যায্য দাবি, কৃষকদের বাঁচার দাবি তাঁরা চায়, এর প্রমাণ এই হরতালের মধ্যে হয়েই গেল।’
১৯৬৬ সালে কনভেনশন মুসলিম লীগের সমাপ্তি অধিবেশনে দেশের সার্বভৌমত্ব-অখন্ডতা বিরোধী কোন প্রচেষ্টা তার সরকার সহ্য করবে না বলে জানান। এই ঘোষণার পর শেখ মুজিবকে বারবার গ্রেফতার করা হয়। চলমান বিভিন্ন মামলায় একের পর এক জামিন পেলে সর্বশেষ শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। এই মামলা বাঙালির জন্য শাঁপে বর হয়ে গেল। জেলের তালা ভাঙবো শেখ মুজিব কে আনব এই স্লোগান বাঙলার আকাশে বাতাসে ভাসতে লাগলো। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন সারাদেশে শুরু হয় তীব্র গণ আন্দোলন।
বাঙালির তীব্র গণ আন্দোলনের মুখে আইয়ুব সরকারের পতন ঘটে। ক্ষমতা দখল করেন সেনাবাহিনীর প্রধান ইয়াহিয়া খান। অনেক সংগ্রাম ও ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে মুক্ত বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেন। সমগ্র পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।
কিন্তু বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশের মানুষ তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন।
মূলত ছয় দফা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, ছয় দফার বাস্তবায়ন ছাড়া বাঙালির জাতির মুক্তি সম্ভব নয়। তাই এই অকুতোভয় বীর দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে পেরেছিলেন, ‘সরাসরি রাজপথে যদি আমাকে একা চলতে হয়, চলব। কেননা ইতিহাস প্রমাণ করবে বাঙালির মুক্তির জন্য এটাই সঠিক পথ।’
অসহযোগ আন্দোলন থেকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জন করে বাঙালি জাতি। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক জান্তা গণহত্যা শুরু করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। ৯ মাসের যুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। বাঙালিরা একটি জাতি হিসেবে বিশ্বে মর্যাদা পায়, পায় জাতিরাষ্ট্র—স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ।