আমাদের আবার ঈদ!
মর্জিনার মা। দুই সন্তান নিয়ে থাকেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের মাটিকাটা এলাকায়। মানুষের বাসায় ছুটা কাজ করেন। এবার ঈদের দিন সন্তানদের মাংস দিয়ে ভাত দিতে পারেননি। বললেন, গ্রামে থাকলে ঠিকই সমাজ থেকে এক দুই টুপলা গোশত পাইতাম। এই শহরের মানুষ ঈদের দিন গেট আটকিয়ে দেয়। যাদের বাসায় কাজ করেছি; তাদের গেটই খোলে নাই।
সাজ্জাদ (ছদ্মনাম)। গণমাধ্যমকর্মী। কাজ করেন একটি জাতীয় দৈনিকে। সন্তান-স্ত্রী নিয়ে রাজধানীর ভাটারা এলাকায় ভাড়া থাকেন। তাদের হাউজের কর্মীদের এখনো মে মাসের বেতনই দেওয়া হয়নি। ধার-কর্জ করে চলছেন। তিনি বললেন, ঈদের একটা দিন; স্ত্রীর কথা বাদই দিলাম। মেয়ের মুখে এক টুকরো মাংস দিতে পারিনি। আমাদের আবার ঈদ!
ঈমান আলী। উত্তর ভাষাণটেক এলাকার একটি বাসায় সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করেন। এবার ঈদে এলাকা থেকে লোকজন এনে বাড়ির মালিকদের তিনটি গরুর মাংস কাটার কাজ করেছেন। বললেন, টাকা তো ঠিকই পাইছি কিন্তু ভেবেছিলাম কেউ না কেউ একটু মাংস দিবোই। কিন্তু আসফোস,এবারের কোরবানিতে কোনো মাংসই খেতে পারিনাই।
গৃহকর্মী মর্জিনার মা, গণমাধ্যমকর্মী সাজ্জাদ কিংবা সিকিউরিটি গার্ড ঈমান আলী নয়, ঢাকা শহরে থাকা এমন নিম্ন আয়ের অসংখ্য মানুষের ঈদের দিনটা কেটেছে কোরবানির মাংস ছাড়াই। তারা বলছেন, গ্রামে থাকলে ঠিকই সমাজ থেকে কিছু মাংস পেতেন। শহরের মানুষ হাতে গোনা পরিচিত লোকজন ছাড়া আর অন্য কাউকে মাংস দেয় না। আর ভাসমান মানুষের মতো হাত পেতে মাংস নিতে পারেন না তারা।
আজ পবিত্র ঈদুল আজহার দ্বিতীয় দিন। এই ঈদ নিয়ে দেশে করোনাভাইরাস সংক্রণের পর চারটি ঈদ উৎসব উদযাপিত হয়েছে। করোনারকালের এ ঈদকে অনেকেই ঘরবন্দি মানুষের ঈদ বলে আখ্যায়িত করেছেন। রাজধানীসহ সারা দেশের মানুষের মধ্যেই করোনার আতঙ্ক বিরাজ করছে। এরমধ্যেও দেশের অনেক মানুষ ঈদে কেনাকাটা করেছেন, কোরবানিও দিয়েছেন।
কিন্তু দেশের অসহায় দরিদ্র পরিবারগুলোতে নেই ঈদ নিয়ে কোনো আয়োজন, নেই কোনো কেনাকাটার ধুম। রাজধানীতে কাজের স্বপ্নে আসা এসব পরিবারগুলোর বেশিরভাগই ঈদের দিনটি কাটিয়েছেন বাড়তি রোজগারের আশায় কাজ করে। আবার অনেকেই বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন মাংস সংগ্রহের জন্য।
নিম্ন আয়ের মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোরবানির ঈদের সকাল থেকে প্রতিবছরের মতো এবারও মাংসের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়িয়েছেন এসব অসহায় মানুষ। করোনার কারণে এ বছর মানুষ কোরবানি কম দেয়ায় মাংস কম পেয়েছেন তারা। আর কিছু মানুষ লজ্জায় মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে পারেননি। তাদের ঘরে মাংসও যায়নি।
উত্তর ভাষাণটেক এলাকার ফ্ল্যাট মালিক মাসুদ খান জানান, এবার করোনা আতঙ্কের কারণেই তাদের হাউজের সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাসার মেইন গেট বন্ধ রাখার। কোরবানির মাংস সিকিউরিটি গার্ডদের মাধ্যমে কিংবা নিজেরাও বাসার নিচে নেমে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
ঈদের দিন রাজধানীর অনেক বাসার গ্যারেজের সামনে কিংবা বাসার বাইরে নিম্ন আয়ের মানুষদের অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। তাদের অনেকেই মাংস পেয়েছেন।
মাসুদ খান বলেন, এই করোনা সঙ্কটের মধ্যে আমরা তো আর ঝুঁকি নিতে পারি না। মাংস নিতে অনেকেই ফ্ল্যাটের সামনে আসবে। কখন কার মাধ্যমে বাসায় ভাইরাস ঢুকে যাবে। মূলত এইসব মাথায় রেখেই এবার বাসার গেট বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
তিনি জানান, গ্রামের মতো এখানে সেই ব্যবস্থা নেই, কোরবানি দেয়ার পর সবার মাংস একত্র করে প্রতিবেশি বা অসহায়দের মাঝে বিলিয়ে দেয়া হবে। যে যেভাবে পেরেছে দিয়েছে।