রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস’র নেতা সুরেশ কান্তি চাকমা ওরফে হিমেশকে গুলি করে হত্যা করেছে প্রতিপক্ষ দলের সন্ত্রাসীরা।
শুক্রবার (১৭ সেপ্টেম্বর) ভোরে বাঘাইছড়ির উপজেলার ৩৫ নং বঙ্গলতলী ইউপি’র বি ব্লক এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
বিজ্ঞাপন
নিহত সুরেশ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস মূল দল) নেতা ছিলেন বলে নিশ্চিত করেছেন বঙ্গলতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জ্ঞান জ্যোতি চাকমা।
এই ঘটনায় জেএসএস মূল দলের পক্ষ থেকে প্রতিপক্ষ সংস্কারপন্থী দলের সন্ত্রাসীদের দায়ী করলেও দলটির পক্ষ থেকে এই ঘটনায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
স্থানীয়রা জানান, সুরেশ কান্তি চাকমা প্রাণভয়ে আতঙ্কিত হয়ে তার বাড়ির অদূরে আরেকটি বাড়িতে ঘুমাচ্ছিলেন। শুক্রবার ভোর ৪টার দিকে একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাড়িটি ঘিরে ফেলে এবং ঘুমন্ত সুরেশকে গুলি করে পালিয়ে যায়। এই ঘটনার পর থেকে এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে।
বাঘাইছড়ি বাঘাইছড়ি সার্কেলের সহকারি পুলিশ সুপার মো. আব্দুল আউয়াল চৌধুরী জানিয়েছেন, ঘটনাটি শুনে উক্ত এলাকায় থানার অফিসার ইনচার্জের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দলকে পাঠানো হয়েছে তারা ফিরে আসলে বিস্তারিত জানা যাবে।
বেলা ১১টার সময় তিনি জানান, পুলিশ এখনও পর্যন্ত নিহতের লাশ খুঁজে পায়নি। পুলিশের টিমটি ফিরে আসলে আসল ঘটনা বিস্তারিত জানা যাবে।
গাজীপুরের টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে হামলায় তাবলিগ জামাতের সাদপন্থীরা জড়িত দাবি করে তাঁদের গ্রেফতার, বিচার ও নিষিদ্ধ করার দাবিতে আগামী ১০ জানুয়ারি দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দিয়েছেন শুরায়ি নেজাম বা বাংলাদেশের মাওলানা জোবায়ের অনুসারীরা।
একই সঙ্গে যদি তাঁদের এসব দাবি মানা না হয় তবে ২৫ জানুয়ারি দেশের সকল পর্যায়ের ‘প্রতিনিধিত্বশীল আলেমদের’ নিয়ে সম্মেলন করে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলেও জানানো হয়।
শনিবার (৪ জানুয়ারি) রাজধানীর কাকরাইল মারকাজ মসজিদে ওলামা-মাশায়েখ বাংলাদেশ এবং দাওয়াত ও তাবলীগের সাথীবৃন্দ আয়োজিত 'গত ১৭ ডিসেম্বর দিবাগত গভীর রাতে সাদপন্থী কর্তৃক টঙ্গী ময়দানে অতর্কিত হামলা ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার ও বিচারের দাবী এবং দাওয়াত ও তাবলীগের চলমান ইস্যুতে' এক সংবাদ সম্মেলনে এসব জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে মূল বক্তব্য তুলে ধরেন জোবায়েরপন্থী হিসেবে পরিচিত মাওলানা নাজমুল হাসান কাসেমী।
টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে এর আগেও সাদপন্থীরা হামলা ও হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে দাবি করে নাজমুল হাসান কাসেমী বলেন, ২০১৮ সালেও টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে হামলা ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ওই ঘটনার বিচার হলে, ২০২৪ এর ডিসেম্বরে হামলা ও হত্যার ঘটনা ঘটতো না। এবারও যদি হামলাকারীরা ছাড় পেয়ে যায়, তবে ভবিষ্যতে আবারও এমন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সাদপন্থীদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ ‘অপশক্তির যোগসাজশ’ আছে দাবি করে তাঁদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান নাজমুল হাসান কাসেমী।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে তাবলিগ জামাত দুই ভাগে বিভক্ত। এর এক ভাগে ভারতের মাওলানা সাদ কান্ধলভির অনুসারীরা, অন্য ভাগে শুরায়ি নেজাম বা বাংলাদেশের মাওলানা জোবায়েরের অনুসারীরা। ১৭ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে ইজতেমা ময়দানে জোবায়েরপন্থীদের সঙ্গে সাদপন্থীদের সংঘর্ষে তিনজন নিহত হন। এ ঘটনায় ১৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সাদ কান্ধলভির অনুসারী হিসেবে পরিচিত ২৯ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরও কয়েক শ জনকে আসামি করে টঙ্গী পশ্চিম থানায় হত্যা মামলা করেন জোবায়েরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত এস এম আলম নামের এক ব্যক্তি। এ মামলায় ১৯ ডিসেম্বর রাতে টঙ্গী পশ্চিম থানার মুফতি মুয়াজ বিন নূরকে রাজধানীর খিলক্ষেতের বাসা থেকে গ্রেফতারর করে পুলিশ। এদিকে টঙ্গীতে হামলা ও হত্যার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছেন সাদপন্থীরা। পাশাপাশি মুয়াজ বিন নূরের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেছেন তাঁরা।
তাবলিগ জামাতের একটি পক্ষ জোবায়েরপন্থীদের সংবাদ সম্মেলনে হেফাজত ও খেলাফত মজলিসের নেতাদের উপস্থিতির বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মামুনুল হক বলেন, এখানে তাঁরা হেফাজতের নেতা হিসেবে নয়, আলেম-ওলামা হিসেবে এসেছেন। তাবলিগ জামাতের কার্যক্রম যদি ইসলাম ধর্মের কাজ হয়ে থাকে, তবে কোরআন ও সুন্নাহর বিষয়ে সিদ্ধান্ত আলেমরাই দেবেন। তাবলিগের দুই পক্ষের সমস্যা সমাধানে আলেমেরা মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করেছেন। সরকারও চেষ্টা করছেন।
মামুনুল হক বলেন, টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে তিনজনকে হত্যা করা হয়েছে। হামলা ও হত্যার শাস্তি হওয়া উচিত। তাবলিগের কাজ নিয়ে ভারতের একজন ব্যক্তির বিতর্কিত মন্তব্যে সে দেশে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের এই সমস্যা যেন বাংলাদেশে টেনে আনা না হয়। এখন বাংলাদেশে সবাই মিলেমিশে কাজ করলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তবে যারা হত্যায় জড়িত তাঁদের বিচার হতেই হবে। হত্যাকাণ্ডের বিচার বিচারের জায়গায় আর আলোচনা আলোচনার জায়গায়।
টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে প্রথম পর্বের ইজতেমা ৩১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে জানিয়ে মামুনুল হক বলেন, প্রথম পর্বের ইজতেমা অনুষ্ঠানের কাজ চলমান আছে। এটি যথাসময়ে হবে। তবে ১৭ ডিসেম্বরের হামলা ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়েছে দাবি করে মামুনুল হক বলেন, সাদপন্থীরা ইজতেমা অনুষ্ঠানের নৈতিক অধিকার হারিয়েছে। হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, হেফাজতে ইসলামির আমির আল্লামা শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, চট্টগ্রাম হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক আল্লামা খলিল আহমদ কোরাইশী, হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা শায়েখ সাজিদুর রহমান, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুর হক।
রাজধানীর পল্লবীতে মায়ের পরকীয়া প্রেমের বলি ছয় মাসের শিশু আমেনা হত্যার ঘটনার রহস্য উদঘাটনসহ হত্যার ঘটনায় জড়িত দুই জনকে গ্রেফতার করেছে ডিএমপির পল্লবী থানা পুলিশ। গতকাল শুক্রবার গভীর রাতে পল্লবী থানা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়।
শনিবার (৪ জানুয়ারি) ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেসন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।
গ্রেফতারকৃতরা হলো- শিশুটির মা মোসা.ফাতেমা বেগম (২৫) ও ফাতেমা বেগমের পরকীয়া প্রেমিক মো. জাফর (৩৬)।
পল্লবী থানা সূত্রের বরাতে তালেবুর রহমান বলেন, গত ৬ ডিসেম্বর বিকাল আনুমানিক ৩টা ১০ মিনিটে দিয়াবাড়ির মেট্রোরেলের ১২৪ নং পিলার সংলগ্ন লেকপাড় হতে একটি ব্যাগের মধ্যে কাপড়ে মোড়ানো অবস্থায় একটি শিশুর মৃতদেহ পাওয়া যায়। শিশুটির সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির সময় পুলিশ দেখতে পায় তার গলায় সন্দেহজনক আঘাতের দাগ রয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে পল্লবী থানায় অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত হত্যা মামলা রুজু করে।
মামলাটি তদন্তের একপর্যায়ে মৃত শিশুটির পরিচয় সনাক্ত করা হয়। পুলিশ নিশ্চিত হয় শিশুটির নাম আমেনা ও তার বয়স ৬ মাস। পরিচয় সনাক্তের পর গোপন তথ্যের ভিত্তিতে শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) গভীর রাতে পল্লবী এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে মৃত শিশুটির মা মোসা. ফাতেমা বেগম (২৫) কে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে নিবিড় তদন্ত ও পর্যবেক্ষণ করে ফাতেমা বেগমকে জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ নিশ্চিত হয় মো. জাফর (৩৬) নামে এক ব্যক্তির সাথে শিশুটির মা ফাতেমা বেগমের পরকীয়া প্রেমের কারণে শিশু হত্যার ঘটনাটি ঘটে। ওই রাতেই জাফরকে গ্রেফতার করে পল্লবী থানা পুলিশ।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে তিনি আরও বলেন, গ্রেফতারকৃতরা দুজনেই বিবাহিত এবং পল্লবী এলাকায় বসবাস করত। জাফর একটি গার্মেন্টসে কাজ করে। শিশুটির মা ফাতেমা আগে ওই গার্মেন্টসে কাজ করার সুবাদে জাফরের সাথে প্রেমের সর্ম্পক গড়ে উঠে। ফাতেমার স্বামী গ্রিলের মেকানিক হিসেবে কাজ করায় কর্মসূত্রে বাসার বাইরে থাকার সুযোগে তারা দীর্ঘদিন ধরে পরকীয়া প্রেমে লিপ্ত ছিলো। তাদের মাঝে নিয়মিত শারীরিক সর্ম্পক হতো।
গত ৫ অক্টোবর রাত আনুমানিক ৮টার দিকে জাফর ফাতেমার বাসায় শারীরিক সর্ম্পকের জন্য আসে। শিশুটির কান্নাকাটির কারণে তাদের শারীরিক সর্ম্পকে ব্যাঘাত ঘটায় শিশুটিকে প্রথমে স্যুপের মধ্যে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে খাইয়ে অচেতন করা হয় এবং পরে বালিশ চাপা দিয়ে ও গলায় রশি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে বিছানার চাদর দিয়ে শিশুটির লাশ মুড়িয়ে কাপড়ের একটি শপিং ব্যাগে ঢুকানো হয়। জাফর শপিং ব্যাগে করে লাশটি নিয়ে মেট্রোরেলের একটি পিলারের কাছে ফেলে আসে।
ময়মনসিংহের নান্দাইলে কলেজ ছাত্র মুরাদ হাসান (১৭) হত্যা মামলার মূলহোতা ছাত্রলীগ নেতা আশরাফুল আলম হামিম (২৩) বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার সময় বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
গ্রেফতারকৃত আশরাফুল আলম হামিম উপজেলার আলাবক্সপুর এলাকার মো. আবুল কালামের ছেলে। সে নান্দাইল শহীদ স্মৃতি আদর্শ ডিগ্রি কলেজ শাখার ছাত্রলীগ নেতা।
শনিবার (৪ ডিসেম্বর) দুপুরে নান্দাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফরিদ আহমেদ গ্রেফতারের সত্যতা নিশ্চিত করে তিনি বলেন চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলায় আসামিদের গ্রেফতারের অভিযান চলছিলো। এরই ধারাবাহিকতা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আমরা জানতে পারি হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা হামিম বিদেশ চলে যাওয়ার জন্য সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন। এর ফলে যেকোন সময় তিনি বিদেশে পাড়ি দিতে পারেন। এ অবস্থায় গতকাল শুক্রবার রাতে কাতার যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে তাকে বিমানবন্দর থানা পুলিশের সহায়তায় গ্রেফতার করা হয়।
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফরিদ আহমেদ আরও বলেন গ্রেফতার হওয়া আসামিকে নান্দাইল থানা পুলিশের হেফাজতে নিয়ে আসার কাজ প্রক্রিয়াধীন বিস্তারিত সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে পরে জানানো হবে।
উল্লেখ্য যে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ২০২৪ উপলক্ষে ৩১ শে মে রাতে নান্দাইল উপজেলার সদরে আনারস প্রতীকের নির্বাচনী লিফলেট বিতরণের সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ছুরিকাঘাতে কলেজ ছাত্র মুরাদ নিহত হয়।পরে এ ঘটনা ১ জুন নিহতের পিতা তোফাজ্জল হোসেন ভূইয়া বাদী হয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীসহ ১১ জনের নামে হত্যা মামলা দায়ের করেন।
বিভিন্ন দাবি নিয়ে সাভার-আশুলিয়ার মাঠ গরম ছিল গত বছরের অর্ধেকটা সময়। প্রায় প্রতিদিনই গণমাধ্যমের শিরোনামে হতো সাভার আশুলিয়ার ঘটনা। জুলাই-আগষ্টের গণঅভ্যুত্থানের আলোচিত ঘটনার নির্মম সাক্ষী এই শিল্পাঞ্চল। চলছিল আন্দোলন সংগ্রাম, রক্তে ভিজেছে রাজপথ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে প্রায় অর্ধশত প্রাণহানি এছাড়াও আরও হাজারো আহত মানুষের আর্তনাদ এই শহরে। তারমধ্যে জীবন যুদ্ধের নানা দাবিতে চলতে থাকে পোশাক শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন। সড়ক মহাসড়ক অবরোধ। হামলা-ভাংচুর। আহত নিহতের ঘটনা। টানা ৩২ ঘণ্টা মহাসড়ক অবরোধের ঘটনাও রয়েছে। সেই অস্থিরতা কমলেও এখনো যেন শেষ হয়নি। সাভার ও আশুলিয়ার বছর শেষ হয়েছে অস্বস্তির আর অনিশ্চয়তার খবর। আর প্রশাসন বলছে, অতিদ্রুত সাভার ও আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের সার্বিক পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।
২০২৪ এর জুন থেকে ডিসেম্বর:
জুলাই ও আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে তৎকালীন সরকার সমর্থিত সংগঠন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বর্বরতার শীর্ষ কয়েকটি এলাকার মধ্যে ছিল আশুলিয়া ও সাভার অঞ্চল। ইয়ামিন থেকে নাম না জানা অনেকে ছিলেন মৃত্যুর মিছিলের প্রথম সাড়িতে। মাত্র ১৫দিনের ব্যবধানে শহিদ হয়েছেন বিভিন্ন পেশার অর্ধশত মানুষ। আহত হয়েছিলেন হাজারের বেশি। আন্দোলনের শেষ দিন ৫ আগস্ট সৈরাচার শাসক শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার দিন তাণ্ডবে নিহত হন প্রায় অর্ধশত। তারপর হতাহতের নিয়ে হাসপাতালে ছোটাছুটি। বিক্ষুব্ধ জনতার ক্ষোভের আগুনে পুড়ে যাওয়া সাভার ও আশুলিয়ার দুই থানাই অচল হয়ে পড়ে। প্রায় এক সপ্তাহ পর সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় থানাগুলো স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরুর চেষ্টা করা হয়। বছরের শেষ দিনগুলোতে এখনো ছাত্র-জনতার ক্ষত আর স্মৃতি বয়ে বেড়াছে এই উপজেলাটি।
সাভার ও আশুলিয়ায় যা ঘটেছিল ছাত্র-জনতার আন্দোলনে:
জুলাইয়ের শুরুতেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে বিভিন্ন কর্মসূচী দেয়। সাথে চলে মহাসড়কে অবরোধের মত ঘটনাও। ১৫ জুলাই মধ্য রাতে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনা উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয়। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে মুখোমুখী অবস্থানে চলে যায় ছাত্রলীগ। পরে সিন্ডিকেট সভায় শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশনা আসলেও মানতে রাজি ছিলেন না অধিকাংশ সাধারণ শিক্ষার্থী। পরবর্তীতে ১৭ জুলাই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করতে অভিযান চালায় পুলিশ। সেই অভিযানের নেতৃত্বে দেন তৎকালীন ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ হিল কাফী। পুলিশের তান্ডবে ছত্রভঙ্গ হলেও অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা আশপাশের এলাকায় আত্মগোপনে চলে যান।
তৎকালীন সরকার ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলেও ১৮ জুলাই কোটা সংস্কার চেয়ে ও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনার বিচার চেয়ে মাঠে নামে সাভারসহ আশপাশের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। তাদের উপর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার সমর্থিত বিভিন্ন সংগঠন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাণ্ডব চালায়। ১৮ জুলাই শিক্ষার্থী ইয়ামিনসহ মারা যান অন্তত চারজন।
১ঌ জুলাই ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভার বাসস্ট্যান্ড এলাকা অবরোধ করে চলে বিক্ষোভ। দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার উপর দেশী-বিদেশী অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় আওয়ামী লীগ সরকার সমর্থিত বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী সেদিন মারা যান চার জন। এদিন কয়েক হাজার সাধারণ শিক্ষার্থী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জড়ো হয়েছিলেন। ২০ জুলাই সকালে পুলিশের গুলিতে মারা যায় ব্যবসায়ীসহ দুইজন। ২৯ জুলাই থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আশপাশের বিভিন্ন এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন। পরবর্তীতে ৪ আগস্ট তারা পুনরায় সাভার বাসস্ট্যান্ড অবরোধ করার চেষ্টা করে। এবার তাদের সঙ্গে যোগ দেন নানা পেশাজীবীর হাজারও সাধারণ মানুষ।
এছাড়া একই দিনে আশুলিয়ার বাইপাইল বাসস্ট্যান্ডে অবরোধের সময় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। তাদের নির্বিচারে চালানো গুলিতে নিহত হন এক শিক্ষার্থী। এখবর ছড়িয়ে পরলে আন্দোলনে যোগ দেয় বিভিন্ন পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা। পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ৫ আগস্ট আরও বর্বর হয়ে ওঠে পুলিশ। সকাল থেকে ঢাকা লং মার্চ শুরু করে আশুলিয়ার বাইপাইল ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেইরী গেইট জড়ো হয় শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ। এদিন দুপুর থেকে বাইপাইল বাসস্ট্যান্ডে নির্বিচারে গুলি করে পুলিশ। সাভারেও একই তাণ্ডব চালানো হয়। তাদের তাণ্ডবে নিহত হন অন্তত অর্ধশত মানুষ। আহত হয় হাজারেও বেশি। তবে এদিন আশুলিয়া থানা এলাকায় ঘটে যায় সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ঘটনা। গুলিবিদ্ধ ছয়জনকে ভ্যানে তুলে পুড়িয়ে গুম করার চেষ্টা করেছিল পুলিশ। পিটিয়ে মারা হয় তিন পুলিশ সদস্যকে।
আন্দোলনে শ্রমিকেরা:
গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে যৌক্তিক ও অযৌক্তিক দাবি নিয়ে আন্দোলনে নেমেছিল বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকেরা। বেতন বৃদ্ধির দাবিতে জুনের বিভিন্ন সময় শ্রমিকেরা মাঠে নামলেও প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে ছিল পোশাক শ্রমিকদের এ আন্দোলন। তবে আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর দ্বিতীয় সপ্তাহে চাকরিতে নারী পুরুষ নিয়োগ বৈষম্য দূর করার জন্য আন্দোলন শুরু করে চাকরিপ্রার্থীরা। এরপর থেকে আন্দোলনের মাঝে আটকে যায় আশুলিয়া। প্রতিদিনই নিত্য নতুন দাবি নিয়ে মহাসড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ, মানববন্ধন, কর্মবিরতিসহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। আগস্টের ১২ তারিখ থেকে ঢাকা রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকার প্রধান ফটকের সামনে চাকরিতে বৈষম্যহীন করার দাবিতে বেশ কয়েকদিন আন্দোলন চলে। প্রথমে পুরুষরা শুরু করলেও শেষটা করেছেন নারী চাকরি প্রার্থীরা। এ আন্দোলন রুপ নেয় বিভিন্ন দাবিতে। ছড়িয়ে পরে আশপাশের বিভিন্ন এলাকার কারখানাগুলোতে। কিন্তু সেসব দাবির অধিকাংশ মেনে নিলেও পরবর্তীতে ফিরে আসেনি স্বাভাবিক উৎপাদন।
আশুলিয়ার শারমিন গ্রুপের কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে শ্রমিকরা ২০টি দাবি তুলে ধরেছিলেন। সেখানে উল্লেখযোগ্য ছিল- বৈষম্য না করা ও হাজিরা বোনাস বৃদ্ধিসহ শ্রমিক মারা গেলে কোম্পানির দায়িত্বে গ্রামের বাড়িতে মরদেহ পাঠানো, চাকরিকালীন কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসার খরচ কোম্পানিকে বহন করতে হবে এবং মাতৃত্বকালীন ছুটির টাকা দিতে হবে আগেই।
একই এলাকার নরসিংহপুরে নাসা গ্রুপের কাছে শ্রমিকরা দাবি রেখেছিলেন ১৫টি। ছিল বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি ১০ শতাংশ করা, ঈদে ১২ দিন ছুটি। কিছু দাবির সাথে মিল থাকলে যুক্ত হয় জিএবি লিমিটেড কারখানার শ্রমিকদের শর্ত। তারা কর্তৃপক্ষকে দিয়েছিলেন ১০টি দাবি। দিয়েছেন কারখানার খাবারে সপ্তাহে দুইদিন গরুর মাংস, দুইদিন মুরগির মাংস এবং দুইদিন সবজির সঙ্গে ডিম দেওয়ার দাবি। পাশাপাশি জ্বর, মাথাব্যথার মতো সাধারণ সমস্যায় চিকিৎসা ও ওষুধ দিয়ে এক দিনের ছুটি, বছরে একবার পিকনিকে নিয়ে যাওয়া, কমপক্ষে ১০ বছরের চাকরির নিশ্চয়তা।
এছাড়া সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর জুড়ে সকালে কারখানা চালু হলেও আন্দোলনে দুপুরে কারখানা বন্ধ করতে হয়। অক্টোবর ও নভেম্বর দুটি কারখানার রয়েছে মহাসড়ক অবরোধের প্রতিযোগিতা। সেপ্টেম্বর ৩০ তারিখ থেকে ২ অক্টোবর পর্যন্ত বার্ডস গ্রুপের বকেয়া বেতন ও সার্ভিস বেনিফিটসহ বিভিন্ন দাবিতে নবীনগর চন্দ্রা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন ৫২ ঘণ্টা। এদিকে ২১ থেকে ২২ অক্টোবর আশুলিয়ার বাইপাইল বাসস্ট্যান্ড অবরোধ করে রাখে জেনারেশন নেক্সট লিমিটেড কারখানার শ্রমিকরা। তারা সড়কে ছিলেন ৩২ ঘণ্টা। তবে একদিন বাদে বাংলা বাজার কারখানার সামনে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয় চারজন শ্রমিক। পরে একজন মারা যান। নভেম্বর ও ডিসেম্বর পর্যন্ত অনেক কারখানার ভিতর ছিল কর্মবিরতিসহ বিক্ষোভ। এসময় প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন কারখানা যুক্ত হয়েছে সাধারণ ছুটির তালিকায়।
এদিকে ডিসেম্বর শেষের দিকে বিভিন্ন কারখানার শ্রমিক আন্দোলন ছিল। সর্বশেষ সাভারের বকেয়া বেতন, ওভারটাইম ও ছুটির টাকা পরিশোধের দাবিতে প্রায় ৪ ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে রাখে বসুন্ধরা গার্মেন্টস নামক তৈরি পোশাক কারখানার কয়েক শতাধিক শ্রমিক।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৯৪ মামলা:
থানা সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আশুলিয়া থানায় মামলা হয়েছে ৬৭টি। আসামি গ্রেফতার হয়েছে ১৬৭জন । এদিকে সাভারে জুলাই আগস্টে ছাত্র-জনতা হতাহতের ঘটনায় মামলা হয়েছে ২৭টি। গ্রেফতার হয়েছে ৪০ জনের অধিক।
এছাড়া জুন ও আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শ্রমিকদের আন্দোলনে পুলিশ ও কারখানা কর্তৃপক্ষের দায়ের করা মামলা সংখ্যা ১৭টি। যার ৯টি শিল্প পুলিশ ও ৮টি থানা পুলিশ তদন্ত করছে। আসামি গ্রেফতার হয়েছে ৪০ জনের অধিক।
শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে যা বলছেন শ্রমিকেরা:
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শ্রমিক বলেন, আমরা আন্দোলন করছি আমাদের ন্যায্য পাওনা আদায়ের জন্য। সাধারণ মানুষের কিছুটা ভোগান্তি হলেও আমাদেরকে সমর্থন করেছে। আমাদেরও পরিবার রয়েছে। একটা মাস কাজ করার পর বেতন সর্বোচ্চ ১৫ হাজার। এটা দিয়ে কিভাবে সংসার চালাবো। সেটাও ঠিক মতো পাওয়া যায় না। চার মাসও বেতনের মুখ দেখা যায় না। কিন্ত মালিকরা তো না খেয়ে থাকে না। আবার ছেলে মেয়ের পড়াশোনা। তাই ন্যায্য দাবি নিয়ে আন্দোলন করেছি।
একটি কারখানায় দুপুরের খাবারের সাথে দুইদিন ভাতের সাথে গরুর মাংস দেওয়ার দাবি করেছিলেন। এটা যৌক্তিক কিনা জানতে চাইলে তারা বলেছেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রফতানিমুখী শিল্পখাতে আমরা কাজ করি। আমাদের চাহিদা সবার আগে পূরণের আগ্রহ থাকতে হবে। আমাদের শারীরিক সুস্থতা জরুরী। তাই দাবি জানিয়েছি।
কেমন ছিল দিনগুলো:
জুলাই ও আগস্টে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ সাভার ও আশুলিয়ায় আন্দোলনে ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৯ ব্যাচের সাবেক শিক্ষার্থী নবীনুর রহমান নবীন। তিনি জানান তার অভিজ্ঞতার কথা। তিনি বলেন, স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে রাজপথে আন্দোলন করতে হয়েছে। জুলাইয়ের আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের দমাতে আশুলিয়া থানার পুলিশ বাদি হয়ে ১৭ জুলাই মামলা দায়ের করে। ওই মামলায় আমাকেও আসামি করা হয়। মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার এড়াতে রাত কাটাতে হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। দিনের বেলায় মাস্ক পরে অনেকটা লুকিয়ে আন্দোলনে যোগ দিতে হয়েছে। শহীদ হওয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত ছিলাম। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে আমরা ১০-১৫ জনের দলে ভাগ হয়ে জড়ো হতাম ক্যাম্পাসসহ সাভার ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকায়। এরপর সবাই মিলে বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছি। আমাদের অনেকের সামনে তখন দুটি পথ খোলা ছিল, হয় যৌক্তিক আন্দোলনে জয়ী হয়ে বৈষম্যহীন দেশে মুক্তির স্বাদ পাওয়া আর নাহয় পরাজিত হয়ে মিথ্যা মামলায় স্বৈরাচারী সরকারের বর্বরতার শিকার হওয়া। ছাত্র-জনতা স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটিয়েছে। এবার আমাদের সবার চাওয়া দেশটা সবার হবে, সবার অধিকার নিশ্চিত হবে।
শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ মমিনুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, শ্রমিকদের আন্দোলন হয়েছে এখনও হচ্ছে। আমরা পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক করেছি। চেষ্টা চলছে।