বিপ্লবী নারী প্রীতিলতার আত্মবলিদান দিবসে শ্রদ্ধা

  • আনিসুর বুলবুল
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার

চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়তলী স্টেশনের কাছে ইউরোপীয়ান ক্লাব ছিলো ব্রিটিশদের প্রমোদকেন্দ্র। সন্ধ্যা হতেই ইংরেজরা এই ক্লাবে এসে মদ খেয়ে নাচ, গান এবং আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠতো। পাহাড়ে ঘেরা এই ক্লাবের চতুর্দিকে প্রহরীদের অবস্থান ছিল। একমাত্র শ্বেতাঙ্গ ও ক্লাবের কর্মচারীরা ছাড়া আর কেউ ধারে কাছে যেতে পারতো না। সেখানে লিখা ছিল, 'কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ'।

এই ক্লাবে আক্রমণ করে ব্যর্থ হয় ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবীরা। এরপর সূর্য সেনের পরিকল্পনা অনুযায়ী একজন নারীর নেতৃত্বে ১০ জনের একটি দল শিখে নেয় কীভাবে অস্ত্র চালাতে হয়, প্রয়োজনে কীভাবে খেয়ে ফেলতে হয় পটাশিয়াম সায়ানাইড। সিদ্ধান্ত হয় রাত ১০টা ৪৫ মিনিটের দিকে ক্লাবে আক্রমণ করা হবে। ওই নারীকে পরানো হয় মালকোঁচা দেওয়া ধুতি আর পাঞ্জাবি। চুল ঢাকার জন্য মাথায় পরানো হয় সাদা পাগড়ি এবং পায়ে রাবার সোলের জুতা।

বিজ্ঞাপন

ক্লাবের পূর্বদিকের গেট দিয়ে ওয়েবলি রিভলবার ও বোমা নিয়ে আক্রমণের দায়িত্বে ছিলেন সেই নারী। আর দক্ষিণের দরজা ও উত্তরের জানালা দিয়ে তার সঙ্গীরা। ক্লাবের ভেতরে তখন প্রায় চল্লিশজন মানুষ। তিনি হুইসেল বাজিয়ে আক্রমণ শুরুর নির্দেশ দেওয়ার পরেই ঘনঘন গুলি আর বোমার আঘাতে পুরো ক্লাব কেঁপে উঠে। সব বাতি নিভে যায়। অন্ধকারে ছুটোছুটি করতে থাকে সবাই।

কয়েকজন ইংরেজ অফিসারের কাছে রিভলবার ছিলো। তারা পাল্টা আক্রমণ করে। একজন মিলিটারি অফিসারের রিভলবারের গুলি গিয়ে লাগে সেই নারীর বুকের বাপাশে। তিনি গুলি লাগার পরেও বেঁচেছিলেন। শুধু লজ্জা নয়, আটক হলে ইংরেজদের টর্চারে গোপন তথ্য প্রকাশ হতে পারে এজন্য দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খেয়ে ফেলেন পটাসিয়াম সায়ানাইড। মুহূর্তে মাটিতে ঢলে পড়েন। তাকে আহত বিপ্লবীরা শ্রদ্ধা জানিয়ে চলে যান।

বিজ্ঞাপন

শৈশবে তাকে ডাকা হতো রানি বলে। বিপ্লবী জীবনে তার ছদ্মনাম ছিলো ফুলতারা। তিনি ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম বাঙালি নেত্রী ও প্রথম বিপ্লবী নারী শহিদ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ করে শহিদ হন। এখনও ভারত উপমহাদেশের সংগ্রামী নারী সমাজে প্রীতিলতা বরণীয় ও স্মরণীয়।

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ১৯১১ সালের ৫ মে চট্টগ্রামের ধলঘাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন স্থানীয় পৌর দপ্তরের প্রধান কেরানি জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার এবং মা প্রতিভাদেবী। খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় ছিল প্রীতিলতার প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৯২৮ সালে মাধ্যমিক পাস করেন এবং ১৯৩০ সালে তিনি ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম হন।

১৯৩২ সালে প্রীতিলতা কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে স্নাতক শ্রেণির পরীক্ষায় অংশ নেন। কিন্তু ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকার কারণে প্রীতিলতা কৃতিত্বের সাথে স্নাতক পাস করলেও তার পরীক্ষার ফল স্থগিত রাখা হয়। অবশেষে প্রায় ৮০ বছর পর ২০১২ সালের ২২ মার্চ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে তাঁকে মরণোত্তর স্নাতক ডিগ্রি প্রদান করা হয়।

স্নাতক পরীক্ষা দিয়ে প্রীতিলতা কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম ফিরে আসেন এবং নন্দনকানন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ বীর সাহসী নারী নেত্রী প্রীতিলতা সবসময় চালিয়ে গেছেন স্বদেশী আন্দোলনের কর্মকাণ্ড। এরপর মাস্টারদা সূর্য সেন এর পরিকল্পনা মাফিক ২৩ সেপ্টেম্বর পাহাড়তলী ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণে ১০-১২ জনের একটি দলকে নেতৃত্ব দেন তিনি। এই অভিযানের পর পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে দেশের জন্য আত্মবিসর্জন দেন এই সংগ্রামী নেত্রী।

মাত্র ২১ বছরের জীবনে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার যে দেশপ্রেম, ত্যাগ এবং সংগ্রামী আন্দোলনের উদাহরণ রেখে গেছেন তা ভারত উপমহাদেশের সকল মানুষের জন্য অনুস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। তার আত্মবলিদান দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।