পিতৃপুরুষের ভিটা হারানোর দুঃখ বোঝে না মেঘনা!
‘নদীরে ও নদীরে তুই একটু দয়া কর, ভাঙিসনা আর বাপের ভিটা বসত বাড়ি ঘর।’ - গানের কথায় শিল্পীর দরদ মাখা কণ্ঠে- না-ভাঙার এমন আকুতি জানালেও নদী প্রকৃতির ইশারায় ভেঙেই চলছে।
বড় বড় ঢেউ আছড়ে ভাঙে তীর, ভাঙে জনপদ। সেই সাথে ভাঙে তীরবর্তী মানুষের স্বপ্ন। ভাঙন কবলিত জনপদের এ মানুষগুলো জীবন সংগ্রামের পাশাপাশি নদীর সাথেও সংগ্রাম করে চলে। যদিও একসময় এ মানুষগুলোকে হার মানতেই হয় উত্তাল নদীর কাছে। বাপ-দাদার বসতভিটা নদীর কাছে দিয়ে চলে যেতে হয় কোন অচেনা জায়গায়।
সব হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়া মানুষগুলোর আহাজারি আর বুকফাটা কান্নায় নদীর স্রোত যেন আরও ফুলে ফুলে ঢেউ নামক ফনা তোলে। আর গিলে গিলে খায় বসতভিটা, জনপদ।
গত কয়েকযুগ ধরে লক্ষ্মীপুরের কমল নগর ও রামগতি উপজেলার বিস্তীর্ণ জনপদ একে একে গিলে খাচ্ছে রাক্ষুসে মেঘনা নদী।
সরেজমিনে লক্ষ্মীপুরের কমল নগর উপজেলার ভাঙন কবলিত লুধুয়া বাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ভিটেমাটি ছাড়া হয়ে চলে যাওয়ার এমন একাধিক করুন চিত্র। আপন ভিটার পুরনো বসত ঘর আর পরিবার পরিজন নিয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন এখানকার কয়েকটি বাড়ির একাধিক পরিবার।
এখানে লুধুয়া বাজারে উত্তর পার্শ্বে নুরুজ্জামানের বাড়ি। এই বাড়ি থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরত্বে দেখা যায় রাক্ষুসে মেঘনা নদী। যেকোন সময় মেঘনা আপন বৈশিষ্ট্যে গিলে খাবে আবুল খায়েরের বসতভিটা। তাই ষাট বছরের পুরনো বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন নতুন বসতিতে। হয়তো দুইদিন পরে এখানে এসে দেখবেন অথৈ জলরাশি, ধেয়ে আসা স্রোত। তাই শৈশব, কৈশোর, যৌবনের সব স্মৃতি বুকের বেদনায় সিক্ত করে চোখের জলকনায় মেঘনার বুকে ঢেলে স্বজনদের নিয়ে চলে যাচ্ছেন তিনি।
এদিন দুঃখ ভরা মনে- চোখে মুখে কষ্টের ছাপ নিয়ে সরিয়ে নেওয়া সংসারের মালামাল গাড়িতে বোঝাই দিতে দিতে আবুল খায়ের জানান, ১২ পরিবারের এই বাড়িটি জয়নাল আবেদীন মিঝি বাড়ি। প্রায় ৬০ বছরের পুরনো বাড়ি এটি। শতাধিক লোকের বসবাস ছিলো এ বাড়িতে। এখন মাত্র দুটি ঘর ছাড়া বাকি ঘর ভেঙে অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছেন বাসিন্দারা। কারণ এতদিনে নদী- কয়েক একর ফসলি জমি, পুকুর, বিশাল বাগান সব কেড়ে নিয়ে গেছে। যেকোন সময় নিয়ে যাবে বাড়িটিও। তাই একে একে এবাড়ির সবগুলো পরিবার সরে যাচ্ছে নদী থেকে নিরাপদ দূরত্বের ভূমিতে। তিনি যাচ্ছেন চরকাদিরা এলাকায়।
এ বাড়ির ৮৩ বছর বয়স্ক নুরুজ্জামান ভাঙা আর জড়ানো কণ্ঠে জানান, বাড়ির বাসিন্দাদের মধ্যে যাদের সামর্থ্য আছে তারা হয়তো দূরে কোথাও জমি কিনে আবার নতুন ঘর বাঁধবেন। আর যাদের সামর্থ্য নেই তারা ছিন্নমূল হিসেবে বসবাস করবেন সরকারি বেড়িবাঁধের কোলে।
একই বাজারের দক্ষিন পাশে তাঁদের আরেক প্রতিবেশী আব্দুর রশিদেরও একই পরিণতি।
আড়াই একর জমিজুড়ে বসতবাড়ি, বাগান, পুকুর ও ফসলি খেত ছিলো আব্দুর রশিদের। গত ২০ বছরের ব্যবধানে সর্বনাশা মেঘনা তাকে ভূমিহীন বানিয়ে নিঃস্ব করে দিয়েছে।
পাঁচবার ভাঙনের কবলে পড়েছেন তিনি। এখন আর তার নিজের কোনো জমি নেই।
তাই পরিবার-পরিজন নিয়ে তিনি এখন ভাড়া বাসায় উঠতে যাচ্ছেন।
স্থানীয়দের হিসেবে, এ যাবৎ দুই উপজেলার অর্ধশত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ২৮ টি বাজারসহ বিস্তীর্ণ জনপদ নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের কবলে বাস্তুহারা হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ।
বর্তমানে হুমকিতে রয়েছে চারটি বাজারসহ আরও ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গেল এক বছরের ভাঙনে দুই উপজেলার প্রায় দেড় হাজার পরিবার বসতবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। এই সময়ে বিলীন হয়েছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনাসহ কয়েকশ’ একর ফসলি জমি।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়,১৯৯৫ থেকে মেঘনা নদীর ভাঙন শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত কমলনগরের চরফলকন ইউনিয়নের প্রায় ১০-১২ কিলোমিটার এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ২০০৮ সাল থেকে ভাঙন পরিস্থিতি আরও ভয়াবহরূপ ধারণ করেছে।
এ বিষয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্য ইব্রাহিম খলিল বলেন, " প্রতিদিনই ভাঙছে আর গৃহহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।" মেঘনার ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে পড়া মানুষ অগুনিত বলে জানান তিনি।
চর ফলকন ইউপি চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন বাঘা বলেন," আমাদের বাড়িটিও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। অনেক জমিজমা ছিলো, তার কোনো স্মৃতিচিহ্ন আজ নেই।"
এসময় তিনি জানান,সরকারীভাবে বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প পাশ হয়েছে। মেঘনা উপকূলের লাখ লাখ মানুষ বাঁধ নির্মাণ বাস্তবায়নের দিকেই তাকিয়ে আছেন।