গ্রাহক নিজেই গ্যাসের প্রি-পেইড মিটার বসাতে পারবেন
গ্যাসের আবাসিক গ্রাহকরা চাইলে বাজার থেকে কিনে প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করতে পারবেন। এতে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের বছরে কমপক্ষে ৬ হাজার টাকা সাশ্রয় হবে।
গ্যাসের প্রি-পেইড মিটার ব্যবহারকারি রফিকুল ইসলামসহ অনেকেই এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন। রূপনগর আবাসিক এলাকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, ১ হাজার টাকার গ্যাস রিচার্জ করলে প্রায় ৩ মাসের মতো চলে যায়। অর্থাৎ তার মাসের খরচ সাড়ে ৩’শ টাকার মতো পড়ছে। লালমাটিয়া এলাকার বাসিন্দা আব্দুল হামিদ মিয়াও প্রায় একই রকম তথ্য নিশ্চিত করে বলেছেন, আমি জোর দিয়ে বলতে পারি বড় পরিবার হলেও ৫’শ টাকার বেশি গ্যাস লাগবে না। আমার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৭ জন ১ হাজার টাকার গ্যাস রিচার্জ করলে দুই থেকে আড়াই মাস চলে যায়, ৬০ টাকা মিটার ভাড়াসহ।এই যখন প্রি-পেইড মিটারের অবস্থা তখন মিটারবিহীন গ্রাহকের কাছ থেকে (দুই চুলা) প্রতিমাসে ৯৭৫ টাকা হারে আদায় করে আসছে গ্যাসের বিতরণ কোম্পানিগুলো।
এক সময় বলা হতো আবাসিকের গ্রাহকরা অনেক বেশি গ্যাস পুড়ছে তাই দাম বাড়ানো উচিত। ওই বিতর্কের মধ্যেই ২০১৬ সালে লালমাটিয়া এলাকায় প্রথম পাইলট আকারে প্রি-পেইড মিটার বসানো হয়। এতে রেজাল্ট এলো পুরো উল্টো, দেখা গেলো প্রি-পেইড মিটার ব্যবহারকারিদের বিল আসছে অর্ধেকের কম(দেড়’শ থেকে আড়াই’শ টাকা)। তখন মিটার বিহীন গ্রাহকের মাসিক ৭৮ ঘনমিটারের বিল ছিল ৬৫০ টাকা নেওয়া হতো। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে এই বিল বাড়িয়ে দুইচুলা ৯৭৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ২০১৬ সালে জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেছিলেন, “প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের পাইলট প্রকল্পের রেজাল্ট খুব ভালো। দুই চুলায় মাসে ৩৩ ঘন মিটার গ্যাস সাশ্রয় হচ্ছে”।
পাইলট প্রকল্পের রেজাল্ট দেখে বিপরীত দিকে হাটা শুরু করে বিতরণ কোম্পানিগুলো। তারা গ্রাহকের এই পকেট কাটার কর্মযজ্ঞ অব্যহত রাখতে চায়। এতে একদিকে যেমন বিপুল রাজস্ব আয় হয়, অন্যদিকে বিশাল চুরিকে ধামাচাপার ফন্দি আটতে থাকে। তিতাসে গ্রামের পর গ্রাম চোরাই লাইন থাকলেই তাদের সিস্টেমলস নেই। সবচেয়ে বড় এই বিতরণ কোম্পানিটি একবার সিস্টেম গেইনও (অর্থাৎ গ্যাস যা কিনেছে তার চেয়ে বেশি বিক্রি দেখায়) করেছে। আবাসিক গ্রাহকদের পকেট কাটা টাকা দিয়ে সমন্বয় করা হয়। অন্যদিকে চোরাই লাইনের টাকায় ফুলে ফেপে উঠেছে কর্তাদের ব্যাংক ব্যালান্স, বাড়ি গাড়ি।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের তথ্য মতে দেশে বৈধ আবাসিক গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ৩৮ লাখ গ্রাহকের মধ্যে ৩ লাখ ৬৮ হাজার প্রিপেইড মিটার ব্যবহার করছে। অর্থাৎ প্রতিমাসে সাড়ে ৩৪ লাখ গ্রাহকের পকেট কাটা হচ্ছে। মাসে ৫’শ টাকা হারে ধরলেও মোট টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। পকেট কাটা টাকার পরিমাণ বছরে ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।এই হিসেব বড় পরিবারের, কিন্তু অনেক ছোট পরিবার রয়েছে যাদের ১ হাজার টাকার গ্যাসে ৪ থেকে মাস চলে যায়। যুগ যুগ ধরে চলছে এই পকেট কাটার মহোৎসব।
গ্যাসের বিতরণ কোম্পানিগুলো মিটার স্থাপনের বিষয়েটি নিজের হাতে রাখতে মরিয়া। একদিকে মিটারের দর বেশি দেখিয়ে টু-পাইপ কামানো, অন্যদিকে, ধীর গতিতে কাজ করে কম গ্যাস দিয়ে বেশি দর আদায় করে।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ইনস্টলেশন অব প্রি-পেইড গ্যাস মিটার প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী ফয়জার রহমান বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমাদের এখন পর্যন্ত ৩ লাখ ৮ হাজার গ্রাহক প্রি-পেইড মিটারের আওতায় এসেছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই আরও ২৫ হাজার মিটার স্থাপন শেষ হবে। আরও দু’টি প্রকল্প পরিকল্পনাধীন রয়েছে। একটি ৭ লাখ মিটার অপরটিতে ৫ লাখ ৪৯ হাজার মিটার স্থাপনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
খোলা বাজার থেকে মিটার ক্রয় প্রশ্নে তিতাসের পরিচালক (অপরেশন)প্রকৌশলী রানা আকবর হায়দারী বার্তা২৪.কমকে বলেন, বিষয়টি পেট্রোবাংলা দেখছে, তারা ভালো বলতে পারবেন।
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক (আইটি এন্ড প্রিপেইড মিটারিং) প্রকৌশলী মু. রইস উদ্দিন আহমেদ বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমাদের ৬০ হাজার গ্রাহক প্রি-পেইড মিটার ব্যবহার করছে। আরও ১ লাখ মিটার স্থাপনের প্রকল্প চলমান রয়েছে। নীতিমালার কথা শুনেছি কিন্তু এখন দেখা হয় নি।
বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির উপ-মহাব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা)প্রকৌশলী মোস্তফা মাহিন সোহাগ বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমাদের কোম্পানিতে সিস্টেম ডেভেলপ করা হয় নি প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করতে হলে তার আগে সফটওয়ার ডেভেলপ করতে হবে। আমরা একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সিস্টেম উন্নয়ন করার জন্য।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) ২০১৮ সালে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আদেশে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের দ্রুত করার আদেশ দেন। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর ২০১৯ সালে নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। সেই নীতিমালায় বলা হয়েছে গ্রাহক নিজের পছন্দমতো দোকান থেকে মিটার ক্রয়করে বিতরণ কোম্পানিতে জমা দেবেন। বিতরণ কোম্পানিগুলো পরীক্ষা করে স্থাপন করবে।
নীতিমালার প্রি-পেইড/স্মার্ট মিটারের স্ট্যান্ডার্ড ও টেকনিক্যাল স্প্রেসিফিকেশন চুড়ান্ত করার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি এবং মিটার যাচাই-বাছাইয়ের জন্য কারিগরি কমিটি কাজ করবে। এরপর হিমঘরে চলে যায় কার্যক্রম। অবশেষে চলতি মাসে এই স্প্রেসিফিকেশনসহ চুড়ান্ত নীতিমালা প্রকাশ করা হয়েছে।
যদিও এখনও মিটারের সরবরাহ চেইন তৈরি হয়নি। তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করছে নীতিমালা হওয়ায় এখন আমদানিকারকরা এতে আগ্রহী হবেন। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সদস্য (গ্যাস) মকবুল ই এলাহী চৌধুরী বার্তা২৪.কমকে বলেন, দেরি হলেও কাজটি যুগান্তকারি হয়েছে। এখন গ্রাহকদের সচেতন হওয়া দরকার তাহলেই পকেট কাটা বন্ধ হয়ে যাবে। এই মিটারের দাম ৩০ থেকে ৫০ ডলারের বেশি হওয়ার কথা না, এই টাকা এক বছরেই উঠে আসবে।