ওমিক্রন আতঙ্ক!

বাড়ছে ওমিক্রন আতঙ্ক।
পাশের দেশ ভারতে এসে গেছে কোভিডের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন। কর্নাটক প্রদেশে বৃহস্পতিবার (২ ডিসেম্বর) এই ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়। ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে ভারতীয় মিডিয়ায় বলা হয়েছে, ওমিক্রনে আক্রান্তদের মধ্যে একজন ৬৬ বছর বয়স্ক পুরুষ এবং অন্য জন ৪৬ বছর বয়স্ক নারী। তবে তাদের অন্য কোনো পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। জানানো হয়েছে, আক্রান্তদের আইসোলেশনে রাখাসহ কনটাক্ট ট্রেসিং করে সতর্কতামূলক সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
এদিকে এখন পর্যন্ত বিশ্বের ২৯ দেশে এই ভ্যারিয়েন্ট ধরা পড়েছে। এই ভ্যারিয়েন্টটি শরীরের উপরে অন্য ভ্যারিয়েন্টের থেকে কঠিন প্রভাব ফেলে কিনা তা নিয়ে গবেষণা চলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, আগামি কয়েক দিনের মধ্যে এ সংক্রান্ত নানা প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে।
এমন পরিস্থিতিতে করোনার প্রাদুর্ভাবের দুই বছরের মাথায় নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে উদ্বিগ্ন গোটা দুনিয়া। ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল অন্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগে বিধিনিষেধ ও কড়াকড়ি আরোপ করেছে। কারণ, যারা আগে কোভিডে আক্রান্ত হয়েছে, তারা আবারো ওমিক্রন আক্রান্ত হতে পারেন। যদিও এই ভ্যারিয়েন্ট কতটা সংক্রামক তা এখনো স্পষ্ট নয়। আরটি-পিসিআর পরীক্ষা এই ভ্যারিয়েন্টকে দ্রুত ধরতে সক্ষম বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এই ভাইরাসের উপর কোভিড ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কতটা তা জানার জন্য গবেষণা চলছে বলে সংস্থাটি জানিয়েছে ।
প্রসঙ্গত, বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস নতুন নতুন ধরণ বা স্ট্রেন তৈরি করছে নিজের দুই বছর বয়স হওয়ার আগেই। ডিসেম্বরে দ্বিতীয় জন্মদিনের প্রাক্কালে করোনার অতি নতুন ধরণ ওমিক্রন আবারো পুরো পৃথিবীকে আচ্ছন্ন করেছে ব্যাপক সংক্রমণের ভয়াবহ চাদরে।
কোভিডের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের থেকেও দ্রুত সংক্রমিত হয় ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট। এমন ইঙ্গিতই দিচ্ছেন মহামারি বিশেষজ্ঞরা। দক্ষিণ আফ্রিকায় ওমিক্রনের যে ধরণের সংক্রমণ দেখা গেছে, তার উপর গবেষণার প্রাথমিক পর্যায়ে এমন ধারণাই পাওয়া গেছে। ফলে বিশ্বের দেশে দেশে চলছে সতর্কতা ও প্রস্তুতি।
বিপদের বহুমুখী প্রতাপের মতোই করোনার ধরণগুলোর রয়েছে নামের বাহার। খোদ করোনাভাইরাস নামটির উৎপত্তি লাতিন শব্দ করোনা থেকে, যার অর্থ মুকুট বা হার। করোনা শব্দটি নিজে গ্রিক থেকে এসেছে, যার অর্থ মালা বা হার। নামটি ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে ভিরিয়নের (ভাইরাসের সংক্রামক আকার) বৈশিষ্ট্যমূলক উপস্থিতিকে নির্দেশ করে। ভিরিয়নের বিশাল কন্দাকৃতি পৃষ্ঠ অভিক্ষেপযুক্ত প্রান্ত রয়েছে, যা মুকুটের স্মৃতি তৈরি করে। এর অঙ্গসংস্থান ভাইরাল স্পাইক পেপলোমিয়ার দ্বারা তৈরি হয়েছে, যেগুলো মূলত ভাইরাসের পৃষ্ঠে অবস্থিত প্রোটিন।
এদিকে সদ্যই গোটা বিশ্বে নতুন করে ত্রাস সৃষ্টিকারী করোনাভাইরাসের নতুন স্ট্রেন ওমিক্রন গত ২৫ নভেম্বর প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম শনাক্ত হয়েছিল। তার মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই ইউরোপের একাধিক দেশ, হংকং, ইসরায়েল, এমনকি অস্ট্রেলিয়াতেও দ্রুততম গতিতে ছড়িয়ে পড়ে ঘাতক ভ্যারিয়েন্ট। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোও নতুন আঘাতের সম্ভাব্য বিপদের কারণে রয়েছে প্রচণ্ড ঝুঁকির মুখে।
রোগতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ বা এপিডেমিওলজিস্টদের মতে, এখনও পর্যন্ত পাওয়া কোভিড স্ট্রেনগুলোর মধ্যে ডেল্টার পর সবথেকে বেশি সংক্রামক ওমিক্রন (Omicron)। তবে এই নতুন ভ্যারিয়েন্টের নামকরণের পিছনেও লুকিয়ে রয়েছে সূক্ষ্ম রাজনীতি।
প্রাথমিকভাবে কোনো দেশ থেকে নতুন কোভিড ভ্যারিয়েন্টের সন্ধান মিললে, সেই দেশের নামেই নামকরণ করা হচ্ছিল ভ্যারিয়েন্টটির। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘হু’-এর এই নামকরণ পদ্ধতি নিয়ে তৈরি হয়েছিল বিস্তর বিতর্ক। আর তারপরেই নামকরণের বিকল্প পথে হাঁটে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
প্রথমে গ্রিক অক্ষরমালার বর্ণ দিয়েই চিহ্নিত করা হচ্ছিল সদ্য আবিষ্কৃত স্ট্রেনগুলোকে। আলফা, বিটা, ডেল্টা, গামা- এভাবেই এগোচ্ছিল সেই তালিকা। এই নিয়ম মেনে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে কলোম্বিয়ায় খুঁজে পাওয়া স্ট্রেনটির নাম রাখা হয় ‘মিউ’। যা পারতপক্ষে গ্রিক অক্ষরমালার দ্বাদশ বর্ণ। কিন্তু হিসাব অনুযায়ী, দক্ষিণ আফ্রিকায় সদ্য-আবিষ্কৃত ভ্যারিয়েন্টটির নাম হওয়া উচিত ছিল ত্রয়োদশ গ্রিক বর্ণ ‘নিউ’-এর অনুকরণে। তবে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রাপ্ত বি.১.১.৫২৯ ভ্যারিয়েন্টটির নামকরণে ‘নিউ’ এবং পরবর্তী বর্ণ ‘জি’ বা ‘শি’-কে বাদ দিয়ে পঞ্চদশ বর্ণ ওমিক্রন-কে বেছে নেয় হু।
কিন্তু কেন বাদ দেওয়া হল, এই বর্ণ দুটিকে? না, ‘নিউ’ বর্ণটির মধ্যে কোনো রাজনীতি লুকিয়ে নেই। বরং, ‘নিউ’ বা নতুনের সঙ্গে উচ্চারণগত মিল থাকায়, দ্বিমত তৈরি হওয়ার আশঙ্কায় বাদ দেওয়া হয়েছে এই বর্ণটি। তবে পরবর্তী ‘শি’ বা ‘জি’ বর্ণটিকে বাদ দেওয়ার পিছনে রয়েছে স্পষ্ট রাজনৈতিক কারণ। বিষয়টি স্বীকারও করেছেন ভ্যারিয়েন্ট নামকরণ প্যানেলের শীর্ষ বিজ্ঞানী তথা এপিডেমিওলজিস্ট মার্টিন কুলডর্ফ। হ্যাঁ, চীনের রাষ্ট্রনেতা শি জিংপিং-এর নামের সঙ্গে মিল থাকার জন্যই এই বর্ণটি এড়িয়ে গেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
২০১৯ সালের শেষ লগ্নে করোনা মহামারির ‘জন্ম’ হয়েছিল চীনেই। তারপর গোটা পৃথিবীতে ধীরে ধীরে প্রকোপ বিস্তার করে মারণ ভাইরাস। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, বলসোনারো-সহ একাধিক রাষ্ট্রপ্রধানই সেসময় অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন চীনের দিকে।
রোগতত্ত্বকে এড়িয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় করোনাভাইরাসকে অভিহিত করা হয়েছিল ‘চীনা ভাইরাস’ নামে। জৈবঅস্ত্র তৈরির পরীক্ষাগার থেকে ভাইরাসের সংক্রমণের তত্ত্বও উঠে এসেছিল একাধিকবার। বলা হয়েছিল, চীনের রাজনৈতিক অভিসন্ধির কথাও।
ফলে ভাইরাস নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কের সূত্রপাত হওয়ার পর বিশ্বজুড়েই সামাজিক হিংসার শিকার হয়েছেন এশীয় প্রবাসীরা। বিশেষত আমেরিকায় ভয়ঙ্করভাবে আক্রান্ত হতে থাকেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষেরা। সেই হিংস্রতা ঠেকাতেই এমন কৌশলী পদক্ষেপ নেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তবে বিজ্ঞানীমহলে হু-এর এই সিদ্ধান্ত সমাদৃত হলেও, তা নিয়েও বিতর্ক রয়েই গেছে রাজনৈতিক মহলে। চীনকে প্রাধান্য দিয়ে পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করছেন অনেকেই। কিন্তু রাজনৈতিক ও নেটিজেনদের একাংশের এই বিতর্কের সমাধানের থেকেও এই বিশেষ সংক্রামক ভ্যারিয়েন্টকে প্রতিরোধ করাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ গোটা মানবজাতির।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বৈশ্বিক মহামারির মধ্যে রাজনৈতিক বিতর্কের প্রেক্ষাপটে করোনা নতুন ধরণগুলো গ্রিক হরফে চিহ্নিত করা শুরু করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। গত ৩১ মে নতুন এই নামকরণ পদ্ধতির ঘোষণা দেয়া হয় সংস্থাটির পক্ষে। যারই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাজ্যে শনাক্ত হওয়া ধরণটির নাম হয়েছে 'আলফা'। দক্ষিণ আফ্রিকায় শনাক্ত করোনার ধরল পরিচিতি পেয়েছে 'বেটা' নামে। ব্রাজিলে শনাক্ত হওয়া ভ্যারিয়েন্টটির নাম দেয়া হয়েছে 'গামা'। দ্বিতীয় ঢেউয়ে সমগ্র ভারতকে বিপর্যস্ত করে ফেলা করোনার ধরণের নামকরণ করা হয়েছে 'ডেল্টা'।
তবে এতেও বিতর্ক থামে নি। বরং গ্রিক বর্ণমালায় ২৪টি হরফ থাকায় নতুন করে প্রশ্ন উঠছে, করোনার ২৪টির বেশি ধরণ শনাক্ত হলে নামকরণ কীভাবে হবে? যে কারণে, ভবিষ্যতে এমন হলে নামকরণের নতুন পদ্ধতি আনার ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কারিগরি প্রধান মারিয়া ভ্যান কেরখোভ বলেছেন, ' রাজনীতি নয়, বরং নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্তে কড়া নজরদারির পাশাপাশি গবেষণার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে তথ্য বিনিময় প্রয়োজন। এজন্য, করোনার ধরণ শনাক্ত করে তা রিপোর্ট করায় কোনো দেশের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ করা উচিত নয়। নতুন নামগুলো বৈজ্ঞানিক নামে ব্যবহার হচ্ছে না। বরং বুঝতে সুবিধার জন্য নামকরণের এই সরল পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। কেননা, উচ্চারণ কঠিন হওয়ায় নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলোকে বৈজ্ঞানিক নামে ডাকলে ভুল হওয়ার শঙ্কা থাকে।