মুক্তিযুদ্ধে সর্বাধিক চা শ্রমিকদের গণহত্যার স্মৃতি
অনেকের দৃষ্টিতে ‘চা শ্রমিক’ মানেই - সমাজের নিচু শ্রেণি’র লোক! আসলে তা একেবারেই নয়। কারণ, তারা সম্মিলিতভাবে শ্রম দিয়ে যুগ যুগ ধরে চা শিল্পে অতুলনীয় অবদান পালন করে চলেছেন। শুধু তা-ই নয়, আমাদের মহান মুক্তিযোদ্ধে তাদের অবদান সগৌরবে উল্লেখ করার মতো। চা শ্রমিকদের আত্মত্যাগের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে বাংলার পথে-প্রান্তরে।
দেশব্যাপী এখন বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী যথাযথ ভাবগাম্ভির্যের মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে। এই শ্রেষ্ঠলগ্নে তাদের আত্মত্যাগের কথা উল্লেখ করাই হবে তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর সিলেটের নানা চা বাগানে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সদস্যরা নৃশংস গণহত্যা চালায়। ভাড়াউড়া চা বাগান, দেওরাছড়া চা বাগান, রাজঘাট চা বাগান, কালিঘাট চা বাগান, সুরমা চা বাগান, তেলিয়াপাড়া চা বাগান প্রভৃতি চা বাগানগুলোতে ইতিহাসের নারকীয় গণহত্যার নীরবসাক্ষী হয়ে রয়েছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া ভাড়াউড়া চা বাগানের ৫২জন চা শ্রমিকদের আত্মত্যাগের অবদান আমাদের হৃদয়ের মণিকোঠর আর স্মৃতি থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। সেদিনের রক্তরঞ্জিত সেই মৃত্যুপুরীটি আজ শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা বাগানে স্মৃতিসৌধ হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে।
১৯৭১ সালের ১ মে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভাড়াউড়া চা-বাগানে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যায় প্রাণহারানো ব্যক্তিরা হলেন: ১) হুসেনিয়া হাজরা, ২) মাংগুয়া হাজরা, ৩) ফাগু হাজরা, ৪) হিংরাজ হাজরা, ৫) কৃষ্ণ হাজরা, ৬) চিনিলাল হাজরা, ৭) শরজুয়া হাজরা, ৮) টিমা হাজরা, ৯) শানিচড়া হাজরা, ১০) মহারাজ হাজরা, ১১) নুনু লাল হাজরা, ১২) নকুলা হাজরা, ১৩) রামরাল হাজরা, ১৪) জগো হাজরা, ১৫) বিশ্বম্বর হাজরা, ১৬) হিরচুয়া হাজরা, ১৭) শিবমুরা হাজরা, ১৮) জুহিয়া হাজরা, ১৯) চুন্মি হাজরা, ২০) অমৃত হাজরা, ২১) বিরবলি হাজরা, ২২) রামদেও হাজরা, ২৩) হরপুয়া হাজরা, ২৪) জোছনা হাজরা, ২৫) হরিকুমার হাজরা, ২৬) রামছুরক হাজরা, ২৭) গুরুয়া হাজরা, ২৮) ফেরচুয়া গৌড়, ২৯) রামকৃষ্ণ গৌড়, ৩০) রামচরণ গৌড়, ৩১) গবিনা গৌড়, ৩২) ইন্দ্র ভুঁইয়া, ৩৩) চৈতু ভুঁইয়া, ৩৪) আগ্ন ভুঁইয়া, ৩৫) ডমরুচান্দ তুরিয়া, ৩৬) মাংরা তুরিয়া, ৩৭) ব্রজনারায়ন গোয়ালা, ৩৮) হোল্লা গোয়ালা, ৩৯) রামলাল মাল, ৪০) ক্ষুদিরাম হাজরা, ৪১) রাজকুমার মাল, ৪২) ডুকুয়া তেলি, ৪৩) গঙ্গা বারই, ৪৪) জগদেও কাহার, ৪৫) গঙ্গা কুর্মি, ৪৬) সম মাঝি, ৪৭) কালাচান্দ ঘাটুয়ার, ৪৮) সুখনন্দন রিকিয়াসন, ৪৯) বকই রেলি, ৫০) শিব মুন্ডা, ৫১) ছুটনুনু তুরিয়া এবং ৫২) হারান জাগুয়া হাজরা।
সেদিন যারা গুলিতে আহত হয়েছিলেন এবং লাশের স্তূপ থেকে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে যারা বেঁচে গিয়েছিলেন তারা হলেন: ১) কেদার লাল হাজরা, ২) গোলাপ চান্দ হাজরা, ৩) রামদাড়ি হাজরা, ৪) জুবায়ের হাজরা, ৫) চিনিয়া হাজরা, ৬) কর্মা হাজরা, ৭) ডিকুয়া হাজরা, ৮) কাইলা হাজরা এবং ৯) বাংসিং তুরিয়া। তাঁদের কারও শরীরে গুলি লেগেছিল, কারও লাগেনি। গুলির আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন। তবে তাদের কেউই আর বেঁচে নেই।
শহীদ ফাগু হাজরার একমাত্র ছেলে এবং চা শ্রমিক নেতা বিজয় হাজরা স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমি তখন ছোট ছিলাম। আমার বাবা (ফাগু হাজরা) চা বাগানে ট্রাক্টর চালাতেন। বাবাকে যখন পাকিস্তানীরা ধরে নিয়ে যায় তখন আমিও ছিলাম। আমাকে ‘হট যাও’ (সরে যাও) বলে সরিয়ে দেয়া হয়। চা বাগানের অন্যান্য সবার সাথে বাবাকেও জড়ো করা হয়। তারপর এই বধ্যভূমিতে নিয়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে। ‘টেটেটেটে’ গুলির শব্দে কেঁপে ওঠে চারদিক। আমরা বাগান থেকে তখন পালিয়ে যাই।
ভাড়াউড়া চা বাগানের প্রাক্তন সর্দার জয়রাম হাজরা বলেন, পাকিস্তানী সেনারা এসে ‘চলো, তুমলোক কাজ করেগা’ (চলো, তোমরা কাজ করবে) বলে অনেক মানুষকে নিয়ে বটগাছের নীচে জড়ো করে। তারপর নতুন উদ্বোধন হওয়া কালীবাড়ির সামনে নিয়ে চা শ্রমিকদের গুলি করে হত্যা করে। শ্রমিকদের কাজ দেওয়ার কথা বলে নিয়ে যায়। এই ঘটনাগুলো আমি প্রত্যক্ষদর্শীর কাজ থেকে শুনেছি।