মেয়ে হারিয়ে বাবা পঙ্গু, ছেলে হারিয়ে বার্ন ইউনিটে ধুঁকছেন মা
অভিযান-১০ লঞ্চের আগুনে সন্ধ্যা নদীতে লেখা হয়েছে একেক-একটি দুঃখের মহাকাব্য। কেউ হারিয়েছেন স্ত্রী সন্তান, কেউ বাবা-মা, আবার কেউ হারিয়েছেন স্বজন। আপনজন হারিয়ে কেউ কেউ মুমূর্ষ অবস্থায় হাসপাতালের বেডে মৃত্যুর প্রহর গুণছেন। নিখোঁজ প্রিয়জনের খোঁজে অনেকে সন্ধ্যা নদীর তীর ও হাসপাতালে হাসপাতালে ছুঁটছেন।
ঝালকাঠির লঞ্চ দুর্ঘটনায় আহতদের কয়েকজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। শনিবার (২৫ ডিসেম্বর) সরজমিনে এমন নানা চিত্র দেখা যায় ঢামেকে।
আমার মেয়ে আমার হাতেই মারা গিয়েছে। মেয়ের শখ ছিল বড় চাকরি করবে। ৫ম শ্রেণি পাস করে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে উঠেছে আমার মেয়ে। আমি মেয়েকে ঢাকা দেখাতে নিয়ে এসে মেরে ফেললাম বলেই আর্তনাদ করলেন ঝালকাঠিতে লঞ্চে আগুন লাগার ঘটনায় মারা যাওয়া তাইফিয়ার বাবা মো. বশির উদ্দিন।
বশির উদ্দিনেরও দু'হাত এবং দু'পা পুড়ে গিয়েছে। পায়ের বৃদ্ধা আঙ্গুল ছাড়া আর কোন আঙ্গুল নাই তার। এখনও চেহারায় রক্তের দাগ দেখা যায়। কথা বলার মত শক্তি পাচ্ছেন না বশির। তবুও মেয়ের কথা বলতেই হাঁফিয়ে হাঁফিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন বশির।
বশির বার্তা২৪-কে বলেন, আমার ছেলে-মেয়ে মাত্র দু'জন। মেয়ে আমার বড় সন্তান, ১১ বছর বয়স। ক্লাস ফাইভ পাস করার পর বায়না ধরেছে ঢাকা যাবে, ঘুরবে।
গত রোববার আমার শ্বশুর আলী শিকদারকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে আসি মহাখালী বক্ষব্যাধী হাসপাতালে, সাথে আমার মেয়েকেও নিয়ে আসি। আমার মেয়ে ঢাকায় এসে তার বান্ধবীদের জন্য চকলেট কিনেছে। ঢাকা দেখে মেয়ে আমার কি যে আনন্দ করল।
শুক্রবার শ্বশুর আর মেয়েকে নিয়ে বরগুনা যাওয়ার পথে হারাতে হয় আমার মেয়েকে। বশির বলেন, আমরা বরগুনা অভিযান ১০ এ উঠি। উঠার পর পরই দেখলাম একটা ইঞ্জিন প্রায় বন্ধ হয় আবার থামে। আমরা কর্তৃপক্ষকে জানালে তারা বলেছেন এটা কোন সমস্যা না।
আমি ছিলাম দু'তলায়, ইঞ্জিন বরাবর। রাত তিনটা দিকে যখন আগুন লাগছে, আমি আমার মেয়েকে লঞ্চ থেকে ফেলে দিয়েছি,তারপর আমি লাফ দিয়ে মেয়েকে ধরেছি। মেয়েকে এক হাতে ধরে আমি সাঁতরিয়েছি তবে, কোন কূল কিনারা পাইনি আমি। চারদিকে অন্ধকার ছিল। কিছুই দেখি নাই। একটা নৌকা এসে আমাকে উদ্ধার করে ঝালকাঠি হাসপাতালে নেয়, আর সেখানেই আমার মেয়ে মারা গেছে।
বশির উদ্দিন মেয়েকে হারিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে।
বশিরের দাবি, সরকার যদি আর্থিক কোন সহায়তা করে তা যেন, সঠিকভাবে বণ্টন করা হয়। তার যথার্থ ভাগ যেন সে পাই। আর সেটা যদি বরগুনার ডিসির মাধ্যমে পায় তাহলে আরও ভাল হয়।
এদিকে অগ্নিদগ্ধ হওয়া গোলাম রাব্বির মামা আসাদুজ্জামান বার্তা২৪.কম’কে বলেন, আমার ভাগিনা এবং ভাগিনী সুরাইয়া চাঁদপুর থেকে ওই লঞ্চে উঠেছে। আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর বরিশাল শেরে বাংলায় ভর্তি করলে ভাগিনাকে ঢাকায় রেফার করে। ভাগিনীকেও রেফার করেছে, ঢাকায় আনছে।
আসাদুজ্জামান জানান, ওরা ভাই-বোন কেউ কাউকে ছাড়ে নাই। শেষ পর্যন্ত ভাই-বোন একসাথে ছিল পানিতে। ভাগিনার পুরো ঘাড় পুড়ে গিয়েছে। শেষ পর্যন্ত আমার ভাগিনা তার বোনের চুল টেনে ধরে আগলে রেখেছে।
ঢামেকে থাকা আরেক স্বজন মুন্না শেখ বলেন, আমাদের পরিবারের মোট নয় সদস্য ছিলেন ওই লঞ্চে। বড় ভাই শেখ রাসেল, ভাবি পুতুল, ভাইয়ের দুই ছেলে জীবন এবং ইমন, তার দুই শ্যালক কালু ও রবিন, তার শাশুড়ি, কালুর স্ত্রী রুমা ও অহনাকে নিয়ে বরগুনায় রাসেলের ভাইরার বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছিলেন।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আহত শেখ রাসেলের স্ত্রী পুতুল এবং পুতুলের ছোট ভাইকে বরগুনায় চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। শেখ রাসেলকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আনা হয়েছে।
বাকি ৬ জনের মধ্যে শেখ রাসেলের দুই ছেলে জীবন (১২) ও ইমন (৯) আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে বলে জানান তিনি। বাকিদের এখনও সন্ধান পাননি পরিবারটি।
আরও পড়ুন: লঞ্চে আগুন: নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রীর শোক
নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণে রক্ষা পেলেন পাথরঘাটার ইউএনও
লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের পরিবার পাবে দেড় লাখ টাকা করে