গুম হওয়াদের স্বজনকে সাদা কাগজে সই দিতে চাপের অভিযোগ
গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনকে চাপ প্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। বাসায় বাসায় গিয়ে জেরা, থানায় ডেকে পাঠানো এবং ক্ষেত্রবিশেষে সাদা কাগজে সই নেয়ার মতো ঘটনা ঘটছে বলে বিভিন্ন সূত্রে খবর এসেছে।
বৃহস্পতিবার (১৪ জানুয়ারি) গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের মঞ্চ ‘মায়ের ডাক’ এবং আইন ও সালিস কেন্দ্র (আসক) পৃথক বিবৃতি দিয়েছে।
ভুক্তভোগীদের একটি পরিবার রাজধানীর বাসাবোর আহাম্মদনগরে থাকে। এ পরিবারের ছেলে সবুজবাগ থানা ছাত্রদলের সভাপতি মাহবুব হাসান ২০১৩ সালের ৮ ডিসেম্বর থেকে নিখোঁজ। মাহবুবের ছোট ভাই শাকিল খান একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ১০ জানুয়ারি সবুজবাগ থানা থেকে তার সাথে যোগাযোগ করা হয়। তিনি সব কাগজপত্রসহ থানায় যাওয়ার পর পুলিশ সদস্যরা ফের তার সাথে বাসায় আসেন। তাদের বাবা আবদুল জলিল খান ছেলে গুম হওয়ার পর সাধারণ ডায়েরি করায় তার সাথে কথা বলা জরুরি বলে জানায় পুলিশ। বাসায় গিয়ে পুলিশ সদস্যরা একটি বিবৃতিতে তাদের ৭৫ বছর বয়সী বাবার কাছ থেকে জোর করে সই নেয়ার চেষ্টা করে। আবদুল জলিল সই দিতে অস্বীকৃতি জানালে সাত-আটজন পুলিশ সদস্য তাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হবে বলে হুমকি দেন। অবশেষে রাত ১১টার কিছু পরে পুলিশ তাদের বাসা থেকে চলে যায়। তবে সবুজবাগ থানার ওসি মুরাদুল ইসলাম ওই সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘অভিযোগ সত্য নয়। এমনিই আমরা মাহবুব হোসেনের ভাইকে ডেকেছিলাম। অনেক দিন ধরে নিখোঁজ, আমরা তো খোঁজখবর নিতেই পারি।’
তবে কেউ কেউ ভয়ে সই করে ফেলেছেন বলেও জানা গেছে। এর বাইরে কারো কারো বাসায় পুলিশ বারবার যাচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠে। তাদের একজন বেবি আক্তার। প্রায় ১০ বছর আগে পল্লবীর বাউনিয়া বাঁধ থেকে পুলিশ পরিচয়ে একদল ব্যক্তি ছাত্রদল নেতা তরিকুল ইসলামকে তুলে নিয়ে যায়। গত বুধবার রাতে তার স্ত্রী বেবি আক্তারকে থানায় ডেকে পাঠানো হয়। বেবি গণমাধ্যমটিকে বলেন, ‘ওরা শুধু আমাদের কাছে এসে তরিকুলের খোঁজ করে। আমি বলি, খবর তো আপনাদের কাছে, আমাদের কাছে কী খোঁজেন?’ বেবি আরো জানান, গত রাত ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত পল্লবী থানায় তাদের বসিয়ে রাখা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে পুলিশ এসে তাদের কাছ থেকে তরিকুল গুম হওয়ার পর থানায় করা সাধারণ ডায়েরি, পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ বিভিন্ন সংস্থার কাছে পাঠানো চিঠির অনুলিপি নিয়ে গেছে। এ ছাড়া বিএনপির তৎকালীন ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের (বর্তমানে ২৫ নম্বর) সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলামের বোন সানজিদা ইসলাম বলেন, তাদের বাড়িতেও পুলিশ কয়েকবার এসেছে। তারা খুব মোলায়েমভাবে তার মায়ের সাথে কথা বলেছে এবং ভাইয়ের বিরুদ্ধে কী কী মামলা ছিল সে খবর জানিয়ে গেছে। ঢাকার বাইরেও গুম হওয়া ব্যক্তির স্বজনদের বাড়িতে পুলিশের দৌড়ঝাঁপের খবর পাওয়া গেছে। নোয়াখালী থেকে গুম হওয়া আলমগীর হোসেনের স্ত্রী তাসলিমা আক্তার বলেন, তাকে থানায় ডেকে পুলিশ কথা বলেছে।
গতকাল গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের মঞ্চ ‘মায়ের ডাক’ এক বিবৃতিতে পুলিশি তৎপরতায় নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে। মায়ের ডাকের সংগঠক আফরোজা ইসলামের সই করা ওই বিবৃতিতে বলা হয়, সরকারের নির্দেশে পুলিশ বারবার গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের বাড়িতে বারবার গিয়ে তাদের সাথে কথা বলছে এবং রাতে তাদের থানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গুমের শিকার ব্যক্তি নিখোঁজ হয়েছেন এবং পরিবার তথ্য গোপন করেছে এমন বাক্য লেখা কাগজে সই দেয়ার জন্য পুলিশ স্বজনদের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে। ওই বিবৃতিতে ‘মায়ের ডাকের সদস্যরা আরো জানান, গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা নানা সমস্যা ও মানসিক চাপ নিয়ে জীবনযাপন করছেন। যারা গুম হয়েছেন, তারা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। ফলে এসব পরিবার অর্থকষ্টে আছে। এর মধ্যে হঠাৎ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা চাপ দিয়ে স্বজনদের কাছ থেকে সই নেয়ার চেষ্টাসহ বিভিন্ন তৎপরতায় পরিবারগুলো আতঙ্কিত।
পৃথক বিবৃতিতে আইন ও সালিস কেন্দ্র (আসক) বলেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন আচরণ সম্পূর্ণ বেআইনি। দীর্ঘ দিন ধরে নিখোঁজ থাকা এসব ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা ও জড়িতদের চিহ্নিত করার প্রচেষ্টা জোরদার করার পরিবর্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ ধরনের তৎপরতা অগ্রহণযোগ্য। গুমের শিকার এসব ব্যক্তির পরিবার দীর্ঘ সময় ধরে স্বজনদের ফেরার প্রতীক্ষায় রয়েছে। প্রতিমুহূর্তে এসব পরিবারের সদস্যরা নিরাপত্তাহীনতা ও ভীতির মধ্যে রয়েছেন। এভাবে তাদের হয়রানি করায় তারা আরো বেশি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এ ধরনের তৎপরতা প্রকৃতপক্ষে গুমের শিকার ব্যক্তিদের খোঁজার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টি স্পষ্ট করে তুলছে।
বিজ্ঞপ্তি