বিষফোঁড়া নাব্যতা সংকটে পাটলাই নদী
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলা সীমান্তের নদী পাটলাই। প্রতিবছরই পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে পলি ও বালু নেমে ভরাট হয় নদীর তলদেশ। সঙ্গে পাড় দখল করে প্রভাবশালী ভূমিদস্যু চক্রের অবৈধভাবে স্থাপনা তৈরির মহোৎসব তো চলছেই। সব মিলিয়ে খরস্রোতা নদীতে এখন নাব্যতা সংকট। পানি কমে যাওয়ায় এ সময়ে দেখা দেয় তীব্র নৌ-জট। ২৫ থেকে ৩০ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে তাই লেগে যাচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ দিনেরও বেশি সময়। এর মধ্যে আবার স্থানীয় চাঁদাবাজরা যেন গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে অত্যাচার করে নৌকার মাঝি-মাল্লাদের।
সরজমিনে গিয়ে জানা যায়, মালামাল পরিবহনে তাহিরপুর উপজেলার সঙ্গে সরাসরি কোনো সড়ক যোগাযোগ নেই। বর্ষা ও হেমন্তে কেবল নৌ-পথই ভরসা। প্রতিবছর উপজেলার সীমান্তবর্তী বড়ছড়া, বাগলী, চাড়াগাঁও শুল্ক স্টেশন থেকে কোটি কোটি টাকার কয়লা ও চুনাপাথর এবং উপজেলার বালু ও নুড়িপাথর কিনে সারাদেশে জোগান দেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া সুনামগঞ্জ জেলা সদর ধর্মপাশা, জামালগঞ্জ, বিশ্বম্ভরপুর, মধ্যনগর, ধর্মপাশাসহ পার্শ্ববর্তী নেত্রকোনা, কলমাকান্দা, মহোনগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ভৈরবসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে বিভিন্ন মালামাল আনা-নেওয়া করা হয়। এসব পণ্য পরিবহনের একমাত্র মাধ্যম নদীপথ। কিন্তু নদীর নাব্যতা সংকটের কারণে অক্টোবর থেকেই স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যে ভাটা পড়ে।
স্থানীয়রা জানায়, পাটলাই নদীপথে নাব্যতা সংকটের কারণে কয়লা, বালু ও পাথর বহনকারী আটশতাধিক নৌযান আটকা পড়ে আছে বেশ কয়েকদিন ধরে। এতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় অর্ধলাখ ব্যবসায়ী ও শ্রমিকের জীবনজীবিকা পড়েছে হুমকির মুখে। দীর্ঘদিন আটকে থাকার কারণে নৌকাতেই থাকতে হচ্ছে মালিক-শ্রমিকদের। আর এ সুযোগে উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের পাটলাই নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে স্থানীয় সংঘবদ্ধ চক্র মেতেছে চাঁদাবাজিতে। পাশাপাশি স্থানীয় সোলাইমানপুর বাজারের ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দিয়েছেন দ্রব্যমূল্য। ফলে ব্যবসায় লাভ করতে নেমে এখন নৌযান মালিক ও ব্যবসায়ীদের গুনতে হচ্ছে ক্ষতির হিসাব। নদী খননের কাজ শুরু হলেও দায়িত্বে থাকা লোকজন চলছেন যেন কচ্ছপ গতিতে।
সিফাত অ্যান্ড ঐতিহ্য নামে একটি পণ্যবাহী নৌকার চালক তছলিম মিয়া বলেন, ‘কয়লা ও চুনাপাথর ব্যবসায়ীরা আমাদের নৌকায় কয়লা তুলে দিয়েই তাদের দায় সেরেছেন। লাভ যা তাদেরই হয়েছে। আর যারা মাল কিনে নিচ্ছেন তারা এবং আমরা আছি মহাকষ্টের মাঝে। এখানে আটকে থাকার কারণে স্থানীয় বাজারের ব্যবসায়ীরা দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দিয়েছেন। কিছু কিছু লোক আছে, যারা ইচ্ছা করেই নৌ-জট লাগিয়ে রাখে। জট খুলে যাক তারা চায় না। কারণ এখানকার ব্যবসায়ীদের লাভ হচ্ছে আমরা আটকে থাকায়।’
নৌ শ্রমিক জুলহাস মিয়া, ওয়াসিম মিয়াসহ অনেকেই জানান, পাটলাই নদীর নাব্যতা হারানোর ফলে এ সময় পাটাবুকা থেকে কানামইয়া বিল পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটারের অধিক নৌ-জটের সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় সাত থেকে আটশতাধিক নৌকা ৫-৬ হাজার কোটি টাকার কয়লা, চুুুুনাপাথরসহ বিভিন্ন মালামাল নিয়ে আটকে আছে। এখানে কিছু লোক আছে যারা টাকার বিনিময়ে রাতে নৌকা ছাড়ায়। পুলিশ টহলে থাকলে সাময়িক সময় নৌ-শ্রমিকরা ভালো থাকেন। পুলিশ চলে গেলে চরম আতঙ্কের মধ্যেই সময় পার করেন নৌকার মালিক-শ্রমিকরা।
চুনাপাথর ও কয়লা ব্যবসায়ী রফিক উদ্দিন বলেন, ‘নাব্যতা সংকটের কারণে ৩০ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে হয় ২৫ থেকে ৩০ দিন, কখনো আরও বেশি সময় লাগছে। ক্রেতাদের সময়মতো মালামাল দিতে পারি না। এতে আমাদের ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে।’
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান করুনা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল বলেন, ‘প্রতিবছর নৌজটের কারণে নৌ মালিক-শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা চরম ক্ষতির শিকার হচ্ছেন।’
উপজেলা নির্বাহী র্কমকর্তা মো. রায়হান কবির বলেন, ‘নদীর নাব্যতা সংকটের কারণেই নৌকাগুলো আটকে আছে। খননের কাজ চলমান। নৌজট নিরসনের জন্য আমি সব সময় খোঁজখবর রাখছি।’
এ ব্যাপারে তাহিরপুর থানার (ওসি) মোহাম্মদ আবদুল লতিফ তরফদার বলেন, ‘নদীটির নব্যতা হারানোর কারণে এ নৌজটের সৃষ্টি। আটকে পড়া নৌযানের নিরাপত্তার জন্য সার্বক্ষণিক পুলিশি টহল রয়েছে। আমি নিজে গিয়েও সমস্যা সমাধানে চেষ্টা করছি।