বন্ধ বরো সেচ প্রকল্প, হাহাকার দু'শতাধিক কৃষকের
লক্ষ্মীপুরের বিএডিসি প্রকল্পের একটি বরো সেচ প্রকল্প চালু নিয়ে দুদিনে দুই ধরণের নির্দেশনা দিয়েছেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইমরান হোসেন। এতে চলতি বরো মৌসুমে প্রায় ২৬ একর জমিতে আবাদ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ফলে প্রায় দুইশ কৃষকের মধ্যে হাহাকার দেখা দিয়েছে।
প্রথম চিঠিতে তিনি সেচ পাম্প চালুর অনুমতি দেন এবং পরের চিঠিতে তিনি সেচ পাম্প চালুর আদেশ বাতিল করেন।
কৃষকরা বলেন, চলতি মৌসুমে চারিদিকে বরো ধানের চারা লাগানোর ধুম পড়েছে। কিন্তু পানির অনিশ্চিয়তার কারণে আমরা এখনো জমিতে হালচাল দিতে পারছি না। ধানের চারাগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সময়মতো চারা লাগাতে না পারলে আমাদের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যাবে। ধানের উৎপাদনও কমে যাবে।
জানা গেছে, বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) এর নোয়াখালী, ফেনী ও লক্ষ্মীপুর জেলার ক্ষুদ্রসেচ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতাধীন দুই কিউসেক ইসমাইল এলএলপি স্কীম। সেচ প্রকল্পটির অবস্থান লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মান্দারী ইউনিয়নের পশ্চিম গন্ধব্যপুর গ্রামে। যা 'ইসমাইল সেচ' প্রকল্প নামে পরিচিত। পাশ্ববর্তী ওয়াপদা খাল থেকে স্কীমের পানি সেচ দেওয়া হয়।
স্থানীয় লোকজন ও কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সেচ স্কীম ম্যানেজার ইসমাইলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দেন ওই এলাকার মহিউদ্দিন নামে এক ব্যক্তি। যদিও তিনি একজন অকৃষক। প্রকল্পটি ইসমাইলের কাছ থেকে 'হাতিয়ে' নিতে তিনি উদ্দেশ্যে প্রনোদিত ভাবে অভিযোগটি করেন। যা বিএডিসি এবং কৃষি কর্মকর্তাদের তদন্তে উঠে আসে। তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে উপজেলা সেচ প্রকল্পের সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেনকে গত ২০ জানুয়ারি সেচ স্কীম চালু করার নির্দেশনা দিয়ে চিঠি দেয়। অজ্ঞাত কারণে ২৩ জানুয়ারি আবার ওই চিঠির আদেশ বাতিল করে সেচ স্কীম বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেন তিনি। এতে চরম বিপাকে পড়েছে স্কীমের আওতাধীন প্রায় দুইশত কৃষক।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সেচ প্রকল্পের প্রায় ২৬ একর জমি আনাবাদি পড়ে আছে। কৃষকরা জমিতে কিনারায় আইল তৈরী করে রেখেছেন। তারা পানির অপেক্ষায় আছেন। জমিতে পানি ফেলে ট্রাক্টরের সাহায্যে চাষ করে চারা রোপন করবেন। কিন্তু পাশের এলাকার জমিগুলোতে বরো ধানের চারা লাগানো হয়েছে। সঠিক সময়ে পানি দিলে জমিগুলোতে আরও আগে চারা লাগানো যেত বলে জানায় কৃষকরা।
প্রকল্পের আওতাধীন কৃষক মমিন উল্যা, খলিল মিয়া, শাহ আলম, মফিজ উল্যা ও আব্দুস সহিদসহ কয়েকজনের ভাষ্যমতে বলেন, আমরা সব ঠিকঠাক করে রেখেছি। কিন্তু পানির অভাবে চাষ দিতে পারছি না, তাই ধানের চারাও লাগানো সম্ভব হচ্ছেনা। আরও দুই সপ্তাহ আগে চারা লাগানোর উপযুক্ত সময় ছিলো।
বীজ তলায় থাকা ধানের চারাগুলো নষ্ট হওয়া উপক্রম হয়েছে। কোন কোন বীজ তলা ঝলসে গেছে। চারার বয়স বেড়ে গেলে সেগুলো লাগালে ভালো ফলন আসবেনা এবং ধানের উৎপাদন কম হবে।
তাদের অভিযোগ, সেচ ম্যানেজার ইসমাইলের বিরুদ্ধে অহেতুক অভিযোগ করেছে মহিউদ্দিন। সে নিজে কৃষি কাজের সাথে সম্পৃক্ত নয়। তাই সেচ স্কীম সম্পর্কে তার স্বচ্ছ ধারণা নেই। প্রকল্পটি সে হাতিয়ে নিলে আমরা কৃষকরা সঠিক সেবা থেকে বঞ্চিত হবো।
তারা জানান, গত ১২ বছর থেকে ওই এলাকার কৃষক মো. ইসমাইল হোসেন প্রকল্পটির ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। মো. মহি উদ্দিন মান্দারী ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহিমের সুপারিশ নিয়ে গত ১৯ জুলাই সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে একটি অভিযোগ দায়ের করেন। যদিও অভিযোগের সাথে বাস্তবতার মিল নেই।
এদিকে, গত ১৬ নভেম্বর মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে কৃষকদের পক্ষ হয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে পাল্টা আরেকটি অভিযোগ দায়ের করেন প্রজেক্ট ম্যানেজার ইসমাইল হোসেন ও প্রজেক্টের সভাপতি হারাধন চন্দ্র মজুমদার। এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাকে ব্যবস্থা নিতে বলেন ইউএনও। পরবর্তীতে কৃষি কর্মকর্তারা সরেজমিন গিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।
গত ১৯ জানুয়ারি সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হাসান ইমাম তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। এতে অভিযোগকারী মহিউদ্দিন ভুয়া কৃষক এবং সেচ ম্যানেজার ইসমাইল হোসেন প্রকৃত কৃষক হিসেবে তদন্তে উঠে আসে। এছাড়া মহিউদ্দিনের অভিযোগটি ব্যক্তিস্বার্থে করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ইসমাইল সেচ প্রকল্পের আওতায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ৫ একর জমির প্রদর্শনী রয়েছে। ১৫ জন কৃষক ওই জমিতে বরো ধানের আবাদ করবেন। সেখানে উন্নত মানের ধানের বীজের প্রদর্শনী দেওয়া হবে।
মান্দারি ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আবদুস সহিদ বলেন, প্রদর্শনীর জমিতে কৃষি অফিসের সহায়তায় ১৫ জন কৃষকের মাধ্যমে উন্নত মানের ব্রি-৬৯ জাতের বরো ধানের আবাদ করা হবে। কিন্তু জমিতে সময়মতো পানি না পেয়ে কৃষকরা চারা লাগাতে পারছে না। বীজতলায় চারাগুলো নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। সঠিক সময়ে চারা লাগাতে না পারলে ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে না এবং কৃষকরাও প্রদর্শনীর প্রতি অনাগ্রহ হবে।
স্কীম ম্যানেজার ইসমাইল হোসেন বলেন, ইউএনও মহোদয় আমাকে ২০ জানুয়ারি স্কীম চালু করার চিঠি দেন। আমি সবকিছু ঠিকঠাক করে পাম্প চালু দিতে গেলে মহি উদ্দিন বাধা দেয়। পরে ইউএনও মহোদয় আরেকটি চিঠি দেন পাম্প চালু না করার জন্য। কিন্তু কৃষকরা চাচ্ছে আমি যেন পাম্প চালু করি।
অভিযোগকারী মহি উদ্দিন বলেন, ম্যানেজার ইসমাইল ঠিকমতো পানি দিতো না। সে নিয়মের চেয়ে অতিরিক্ত টাকা আদায় করতো এবং কৃষকদের সাথে খারাপ আচরণ করতো। তাই কৃককদের দাবির প্রেক্ষিতে আমি অভিযোগ করেছি।
বিএডিসির উপসহকারী প্রকৌশলী মো. মামুন বলেন, অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা সেচ প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেছি। কৃষকরা তাদের জমিতে পানি চাচ্ছে। কিন্তু প্রকল্প ম্যানেজার ইসমাইলের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকায় সে সেচ পাম্প চালু করতে পারছেনা। কিন্তু তদন্তে ইসমাইলের তেমন কোন দোষ পাইনি।
মান্দারি ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আবদুস সহিদ বলেন, ইসমাইল একজন কৃষক। সে গত বছর থেকে পানি দিয়ে আসছে। কৃষকরা তার মাধ্যমে পানি সরবরাহ চাচ্ছে। কিন্তু অভিযোগকারী মহিউদ্দিন অকৃষক। স্কীমে সে কোন চাষাবাদ করে না।
সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হাসান ইমাম বলেন, প্রকল্পটি বিএডিসির। এতে আমাদের সম্পৃক্ততা নেই। তবে সেখানের অভিযোগগুলো আমরা তদন্ত করে প্রতিবেদন দিয়েছি। বিষয়টি সমাধান হলে কৃষকরা চাষাবাদ শুরু করতে পারবে।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সেচ কমিটির সভাপতি মো. ইমরান হোসেন বলেন, ইসমাইলের আবেদনের ভিত্তিতে তাকে সেচ পাম্প চালানোর নির্দেশনা দিয়েছি। কিন্তু আরেকটি অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে পাম্প বন্ধ রাখার নির্দেশনা দিই।
কৃষকের ক্ষতির বিষয়ে তিনি বলেন, দুই-একদিনের মধ্যে বিষয়টি সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে।