রাজশাহীতে ছুটিতে সন্দেহভাজন বুকিং সহকারীরা
রাজশাহীতে ট্রেনের টিকিট চোখের পলকেই শেষ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি কয়েকদিন ধরেই আলোচনায়। অভিযোগ উঠেছে, রাজশাহী স্টেশন ঘিরে থাকা কালোবাজারি চক্রের অপতৎপরতায় সাধারণ যাত্রীদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে টিকিট। আর এই চক্রে রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের প্রধান বুকিং সহকারী আবদুল মমিনেরই জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।
টানা কয়েকদিন অনুসন্ধান চালিয়ে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, এই চক্রের পেছনে সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন মমিন ছাড়াও আরও গুটিকয়েক অসৎ বুকিং সহকারী। সম্প্রতি এই চক্রকে ধরতে বিভিন্ন মহল থেকে পশ্চিমাঞ্চল রেল কর্তৃপক্ষসহ প্রশাসনকে তাগাদা দেওয়া হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে সন্দেহভাজন কয়েকজন বুকিং সহকারী গা-বাঁচাতে ছুটি নিয়েছেন। ছুটিতে গেছেন প্রধান বুকিং সহকারীও।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজশাহী রেল স্টেশনের কাউন্টারের দায়িত্বে আছেন ২৬ জন বুকিং সহকারী। এরমধ্যে প্রধান বুকিং সহকারী আবদুল মমিনসহ পাঁচজন এখন ছুটিতে। মমিন এই স্টেশনে বছরের পর বছর দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। এর আগে অনিয়মের অভিযোগের কারণে তাঁকে রাজশাহী স্টেশনের বাইরে বদলি করা হলেও ৬ মাসের ব্যবধানে আবারও রাজশাহী স্টেশনে ফিরে আসেন। তিনি তাঁর দুই জন সহযোগী বুকিং সহকারীকে নিয়ে টিকেট কালোবাজারী নেটওয়ার্ক গুছিয়ে রেখেছেন বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
মমিন ছুটিতে যাওয়ার আগে স্টেশনে দেখা গেছে, তিনি সাধারণত ৬ নম্বর কাউন্টারে থাকেন। এই কাউন্টারে টিকিট নিতে যাওয়া অনেককেই মমিনের কাছে গিয়ে ‘অমুক ভাই’ পাঠিয়েছেন বলতে দেখা গেছে। আর সঙ্গে সঙ্গেই মমিন বের করে দিয়েছেন টিকিট। তবে একই সময় লাইনে দাঁড়ানো অন্যদেরকে টিকিট নেই বলে ফিরিয়ে দিতে দেখা গেছে। মমিন সারাদিন স্টেশনে না এলেও রোজ রাত ৮টা থেকে এই কাউন্টারে থাকেন।
টিকিট কালোবাজারি চক্রে জড়িয়ে পড়া বিষয়ে কথা বলতে প্রধান বুকিং সহকারী আবদুল মমিনকে একাধিকবার ফোন করা হলেও ধরেননি। পরিচয় জানিয়ে এসএমএস দেওয়ার পরও তিনি ফোন ধরেননি। তাই অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি দেশে করোনার প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় ট্রেনের ধারণ ক্ষমতার চাইতে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে যাতায়াতের নির্দেশনা দেয় রেল কর্তৃপক্ষ। টিকিট নিয়ে সংকট বহুদিনের হলেও রেল কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তের পর তা প্রকট আকার ধারণ করে। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে টিকিট কালোবাজারি চক্র। ট্রেনের টিকিট যাত্রার ৫ দিন আগে অনলাইনে ও স্টেশন কাউন্টারে বিক্রি করা হয়। নির্ধারিত মোট আসনের ৫০ শতাংশ অনলাইনে এবং ৫০ শতাংশ কাউন্টারে বিক্রি করা হচ্ছে। তবে টিকেট বিক্রি শুরুর কিছু সময়ের মধ্যেই তা ফুরিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকামুখি চারটি ট্রেনের ক্ষেত্রে টিকিট সংকট প্রকট। অনলাইনে টিকিট নিতে যাত্রীর জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর প্রয়োজন পড়ে। আর কালোবাজারি চক্র নানাভাবে অন্যদের জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর সংগ্রহ করে অনলাইন থেকে টিকিট নামিয়ে নিচ্ছে। আর ট্রেনে টিকিট যাচাইয়ের ব্যবস্থা থাকলেও জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর যাচাইয়ের ব্যবস্থা না থাকায় সেই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে এই চক্র।
রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশন ঘিরে সক্রিয় স্থানীয় কয়েকজন টিকিট কালোবাজারীর সাথে কথা হলে তারা জানান, টিকিট কালোবাজারির সাথে রাজশাহী নগরীর কয়েকটি কম্পিউটারের দোকান, বিমানের টিকেট বিক্রির দোকানসহ শিরোইল, মঠপুকুর, শিরোইল কলোনী ও দড়িখরবোনা এলাকার কয়েকজন যুবক জড়িত। তারা অন্যের জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর সংগ্রহ করে অনলাইনে টিকিট সংগ্রহের পাশাপাশি রাজশাহী স্টেশনের প্রধান বুকিং সহকারীসহ আরও কয়েকজনের সহযোগিতায় দিব্বি চাহিদামত টিকিট পেয়ে যাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকা-রাজশাহী রুটে ৪টি ট্রেন নিয়মিত চলাচল করছে। এই ট্রেনগুলোতে শোভন চেয়ারের ভাড়া ৩৪০ থেকে ৩৭৫ টাকা, স্নিগ্ধা চেয়ারের ভাড়া ৬৫৬ থেকে ৭২৫ টাকা। তবে কাউন্টার থেকে বুকিং সহকারীর মাধ্যমে দালালদের হাতে পৌঁছে তা হয়ে যায় যথাক্রমে ৪২০ থেকে ৪৫০ টাকা এবং ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা, আর ৭৮২ থেকে ৮৬৫ টাকার কেবিনের ভাড়া হয়ে যায় ১ হাজার টাকা। বিশেষ দিন বা ঢাকায় সরকারি চাকরির পরীক্ষার তারিখ থাকলে কালোবাজারে এই টিকিটের দাম আরও বৃদ্ধি পায়।
সম্প্রতি রাজশাহী স্টেশনে টিকিট সংকট নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে অসন্তোষ প্রকাশিত হবার পর কালোবাজারি রোধে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নগর আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ উদ্যোগী হয়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (জিএম), নগর পুলিশের কমিশনার ও র্যাব-৫ এর পরিচালক বরাবর লিখিত আবেদন দিয়েছেন। পশ্চিম রেলের জিএম অসীম কুমার তালুকদার রেলের টিকেট কালোবাজারি রোধে তৎপরতাও শুরু করেছেন। তিনি নিজেও ঢুঁ মারছেন স্টেশনে। এ অবস্থায় ছুটিতে চলে গেছেন সন্দেহভাজন বুকিং সহকারীরা।
পশ্চিম রেলের জিএম অসীম কুমার তালুকদার বলেন, করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারি নির্দেশনা মতো নির্ধারিত আসনের চাইতে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে ট্রেন চলাচল করছে। টিকিট কালোবাজারি রোধে রেল কর্তৃপক্ষ তৎপর রয়েছে। এই কাজে রেলের কেউ জড়িত থাকলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানান পশ্চিম রেলের এই শীর্ষ কর্তা।