করিম উদ্দিন ভরসা নিখোঁজ নাকি অবরুদ্ধ?
সম্পদ নিয়ে সন্তানদের দ্বন্দ্বের জেরে প্রায় সাত মাস ধরে নিখোঁজ রয়েছেন রংপুরের বিশিষ্ট শিল্পপতি, তিনবারের নির্বাচিত সাবেক সাংসদ আলহাজ্ব করিম উদ্দিন ভরসা। তিনি কোথায় কি ভাবে আছেন কেউ জানেন না। ফলে তার নিরাপত্তা নিয়ে পরিবারের সদস্যদের মাঝে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে।
এদিকে করিম উদ্দিন ভরসার ১৬ সন্তানের মধ্যে ৯ সন্তানের করা রিটের প্রাথমিক শুনানি শেষে এক ছেলের জিম্মায় রাখা জাতীয় পার্টির সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য করিম উদ্দিন ভরসাকে আগামী ৬ মার্চ হাইকোর্টে হাজির করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আদালতে হাজিরের সময় যত ঘনিয়ে আসছে ততই তাঁর পরিবারের সদস্যসহ অধীনস্ত কর্মচারী, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, আত্মীয়-স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের মাঝে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়েই চলছে।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, করিম উদ্দিন ভরসার এক সন্তান শিমুল ভরসা জোরপূর্বক তার বেশ কিছু সম্পত্তি নিজ নামে লিখে নিয়ে বা ভুয়া দলিল সৃষ্টি করে বেদখল করে চলেছেন। শিমুল ভরসা ও তার অপর ভাই সিরাজুল ভরসা যোগসাজশ করে ইতোমধ্যে রংপুর নগরীর সেন্ট্রাল রোডস্থ কোটি টাকার সম্পত্তি জোর করে দখলের চেষ্টা করছেন। হারাগাছের পৈতৃক বাড়ির একটি অংশ জবরদখল করেছেন।
জানা গেছে, ভরসা গ্রুপ প্রায় ১৫/২০ আইটেম পণ্য বাজারজাত করে। এছাড়া বিড়ি, ম্যাচ, সিগারেটসহ বিভিন্ন পণ্যের কলকারখানা রয়েছে। রংপুর নগরীর সেনপাড়ার বহু মূল্যবান বাসভবন, শেয়ারবাজারের কোটি কোটি টাকার শেয়ার, রংপুর ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত কোটি কোটি টাকার শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জবর দখল করার চেষ্টা চালাচ্ছেন শিমুল ভরসা ও সিরাজুল ভরসা। তারা ১৬ ভাইবোনের মধ্যে ১৪ ভাইবোন এবং মাকে বঞ্চিত করে তাদের পিতাকে অজ্ঞাত স্থানে লুকিয়ে রেখেছেন। পরিবারের অপর কোন সদস্যকে তার সন্ধান কিংবা দেখা করতে দিচ্ছে না। করিম উদ্দিন ভরসাকে প্রাণনাশের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
একাধিক সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, করিম উদ্দিন ভরসা জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য, রংপুর জেলা জাতীয় পার্টির সাবেক সভাপতি এবং তিন মেয়াদে বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৯১ সালের নির্বাচনে রংপুর-১ (গঙ্গাচড়া) আসনে, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুর-৪ (কাউনিয়া-পীরগাছা) আসন থেকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। রংপুরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা স্থাপন এবং গরিব দুঃখী মানুষের কল্যাণে বিশাল আর্থিক সাহায্য করার জন্য তিনি রংপুর এলাকায় ব্যাপক জনপ্রিয়। কাজেই তার খোঁজ না থাকার বিষয়ে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
বর্তমানে তার বয়স ৮৭ বছর। তিনি বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছেন এবং তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। অসহয়াত্বের সুযোগ নিয়ে তার বিশাল সম্পত্তি কৌশলে হাতিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে তাদের অপর এক ভাই সাইফুল উদ্দিন ভরসা (শিমুল), বড় ভাই সিরাজুল ইসলাম ভরসার সঙ্গে যোগসাজশ করে করিম উদ্দিন ভরসাকে অজ্ঞাত স্থানে লুকিয়ে রেখেছেন বলে অভিযোগ।
এ নিয়ে একাধিক মামলা চলমান রয়েছে বলেও জানা গেছে। মামলা সূত্রে জানা যায়, সাবেক সাংসদ করিম উদ্দিন ভরসা কয়েক বছর আগে আপলাতুন নেছা নামে এক নারীকে বিয়ে করেন। করিম উদ্দিন ভরসার পাশের গ্রাম হারাগাছ পোদ্দার পাড়া আফলাতুন নেসার বাবার বাড়ি। বিয়ের পর করিম উদ্দিন ভরসাকে আপলাতুন নেছা অজ্ঞাত স্থানে লুকিয়ে রেখে বেশ কিছু সম্পত্তি নিজ নামে লিখে নেন। পরে তার সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় তাকে তালাক দেন। করিম উদ্দিন ভরসার সন্তানেরা তাকে নিজেদের জিম্মায় নেয়ার জন্য আদালতে মামলা দায়ের করেন। রংপুরের একটি বিজ্ঞ আদালত ২০২০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর করিম উদ্দিন ভরসাকে সন্তানদের জিম্মায় দেয়ার আদেশ দিলে শিমুল ভরসা আদালতের মাধ্যমে তাকে নিজ জিম্মায় নেন।
শিমুল ভরসার জিম্মায় থাকাকালীন পরিবারের সকলেই তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান। কিন্তু ২০২১ সালের জুন মাস থেকে হঠাৎ করিম উদ্দিন ভরসার কোন খোঁজ পাচ্ছেন না পরিবারের সদস্যরা। জিম্মাদার শিমুল ভরসাও পরিবারের অন্য সদস্যদের কোন তথ্য দিচ্ছেন না। নিরুপায় হয়ে গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর মতিঝিল ডিএমপি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (নং-৫৬১, ৮.০৯.২১) এবং ২৯ সেপ্টেম্ব বনানী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি(নং-২৭২০, ২৯.০৯.২১) করেন করিম উদ্দিন ভরসার দ্বিতীয় পুত্র শফিকুল ইসলাম ভরসা। কিন্তু অদ্যাবধি পিতার সন্ধান না পেয়ে চরম উৎকণ্ঠা আর হতাশায় ভুগছেন তারা।
এদিকে করিম উদ্দিন ভরসার বাকি ৯ সন্তানের করা রিটের প্রাথমিক শুনানি শেষে এক ছেলের জিম্মায় রাখা করিম উদ্দিন ভরসাকে আগামী ৬ মার্চ হাইকোর্টে হাজির করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
করিম উদ্দিন ভরসার ছেলে কামরুল ইসলাম ভরসার সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। মোবাইল ফোনে মেসেজ পাঠানো হলে তিনি পরে কথা বলবেন বলে জানান।
পিতাকে লুকিয়ে রাখার অভিযোগে অভিযুক্ত সাইফুল উদ্দিন শিমুল ভরসা ও সিরাজুল ইসলাম ভরসার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাদেরকেও পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে রংপুর জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক বার্তা২৪.কমকে বলেন, করিম উদ্দিন ভরসা এ অঞ্চলের কৃতি সন্তান। ওনার এবিষয়টি অত্যান্ত অসম্মান জনক। এক সময় রংপুরে জাতীয় পার্টির অভিভাবক ছিলেন। তিনি তিন বারের সংসদ সদস্য। দেশে দানবীর হিসাবে পরিচিত। সম্পদের কারণে তার সাথে যে ঘটনা ঘটানো হচ্ছে তা দুঃখ জনক ও ন্যাক্কারজনক। এমন ঘটনা মেনে নেয়া যায় না।