‘ত্রাণ তো দূর, খোঁজও নিতে আসেনি কেউ’
কুড়িগ্রামের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন অন্তত দেড় লাখ মানুষ। এ অবস্থায় বিশেষ করে চরম দুর্ভোগে পড়েছে দুর্গম চরাঞ্চলের বন্যা কবলিত মানুষজন। চুলা জ্বালাতে না পারায় এবং টিউবয়েল তলিয়ে থাকায় তীব্র হয়ে উঠছে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট।
অন্যদিকে টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে গো-খাদ্য নষ্ট হয়ে যাওয়ায় একমাত্র আয়ের উৎস গবাদি পশুর খাদ্য সংকট নিয়েও চরম বিপাকে পড়েছেন চরাঞ্চলের মানুষ। বন্যা কবলিত এলাকার কাঁচা-পাকা সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় ভেঙে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা।
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা ইউনিয়নের পূর্ব দৈখাওয়ার চরের বাসিন্দা মো. শাহ আলম। আড়াই বিঘা জমিতে বাদাম চাষ করে বন্যার কারণে তুলতে পেরেছেন মাত্র দেড় বিঘা জমির বাদাম। তাও বন্যার কারণে আগাম তোলায় ফলন আশানুরূপ হয়নি বলে জানান তিনি। বানের পানি বাড়িতে ওঠায় পরিবার ও ফসলসহ আশ্রয় নিয়েছেন পূর্ব দৈখাওয়ার চর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তিনি জানান, বন্যার পানি এবার আগের থেকে দ্রুত বেড়েছে। তাই সব বাদাম তুলতে পারিনি। বাড়িঘরে পানি ওঠায় দ্রুত নিরাপদে সরে এসেছি। এখানে ৫ দিন থেকে আছি। কেউ খোঁজও নিতে আসলো না।
একই ইউনিয়নের আইড় মারির চরের দক্ষিণ পাড়ায় ৭ দিন ধরে ৫ সদস্যের পরিবার নিয়ে পানিবন্দী আশরাফুল আলম। ঘরের ভেতরে কোমর পানি ওঠায় মাচা করে জীর্ণশীর্ণ হয়ে বসবাস করছে পরিবারটি। পাশের একটি মাচায় চুলা জ্বালিয়ে কোনমতে একবেলা রান্না হয়। বন্যায় খড়ি ভিজে যাওয়ায় সামনের দিনগুলোতে রান্না হবে কিনা এই নিয়ে শঙ্কায় পরিবারটি। আশারাফুল আলমের স্ত্রী হামিদা খাতুন বলেন, প্রসাব-পায়খানা করতে অনেক সমস্যা হয়। গোয়ালঘরে ২টা গরু ও ২টা ছাগল একসাথে ছোট একটা জায়গায় আছে। এগুলোর খাবারও ঠিকমতো দিতে পারি না। নিজেদের খাবারই দিনে একবেলা রান্না হয়। সেই রান্নার কখনো ভর্তা-ভাত কখনো লবণ-তেল দিয়ে খাই। ত্রাণ তো দূর, এখনো কেউ খোঁজও নিতে আসলো না।
পাশের বাড়ির বাসিন্দা মো. ইব্রাহিম সরকার জানান, বিশুদ্ধ পানির সংকটের কথা। তার বাড়ির উঁচু স্থানে বসানো টিউবওয়েলটিও হাঁটু পানির নীচে। সকালে আলু ভর্তা ভাত খেয়ে বিকেল পর্যন্ত থাকা এখন নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা পরিবারটির। ইব্রাহিম সরকার বলছিলেন, খাবার জন্য পানি পাচ্ছি না। রান্না করতেও অনেক ভোগান্তি, রান্নার জন্যেও তেমন কিছু নাই ঘরে। আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে ফুরিয়ে যাবে। এখন পর্যন্ত কেউ খোঁজ নিতে আসলো না।
অপরদিকে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের পোড়ার চরের (নতুন) একটি উঁচু স্থানে গত ছয়মাস ধরে বসবাস করছে প্রায় ১০০টি পরিবার। বন্যার পানিতে প্রায় ৯০ ভাগ বাড়ি তলিয়ে গেছে। কয়েকটি বাড়িতে এখনো পানি না ওঠায় সেই খানেই ঠাঁই নিয়েছে বাকি পরিবারগুলো। তবে দ্রুত পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আগামী কয়েক ঘণ্টায় বাকি বাড়ি গুলোতেও পানি উঠবে বলে জানিয়েছেন সেখানকার বাসিন্দারা।
তবে পুরাতন পোড়ার চরের প্রায় ৫০টি বাড়ি গত ১০দিন থেকে পানিবন্দী। চরটি নীচু স্থানে হওয়ায় সেখানকার বাড়ি ঘরগুলো প্রায় নিমজ্জিত অবস্থায় রয়েছে। অধিকাংশ বাসিন্দারা নিরাপদ আশ্রয়ে সরে গেলেও কয়েকটি পরিবার এখনো ঘরের ভেতরে মাচা করে বসবাস করছে। গগণমাধ্যমে এই চরের খবর বহুল প্রচারিত হওয়ায় বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি এবং সেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো সেখানে ছুটছেন ত্রাণ নিয়ে। এই চরের তেমনি একটি পরিবার শাহজালাল-মঞ্জিলা দম্পতি। দুই শিশুসহ চারজন সদস্যের এই পরিবারটির ভরসা শুকনো খাবার। শাহজালাল বলছিলেন, রান্নার কোন ব্যবস্থা নাই। ত্রাণের শুকনো খাবারেই আমাদের ভরসা।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, ৯ উপজেলার বন্যা কবলিত মানুষের জন্য ৩৩৮ মেট্রিক টন চাল, নগদ ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ১ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, ১৮ লাখ ৯৫ হাজার টাকার শিশু খাদ্য ও ১৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকা গো-খাদ্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যা বিতরণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্ল্যাহ আল মামুন জানান, ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পানি কমার সম্ভাবনা রয়েছে।