দুদকের গণশুনানিতে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই
বাংলাদেশ পুলিশের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল সময় ১৯৭১ সাল। মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল, বেশ কয়েকজন এসপিসহ অনেক পুলিশ সদস্যরা বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে জীবন বিলিয়ে দেন। সেই থেকেই অপরাধ দমন ছাড়াও মানবিক কাজে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করে সুনাম কুড়াচ্ছেন বাংলাদেশ পুলিশ। করোনাকালে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে অনন্য নজির স্থাপন করেছে তারা।
এক সময় পুলিশের বিরুদ্ধে মানুষের অনেক অভিযোগ ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের কঠোর পদক্ষেপে পাল্টে গেছে পুলিশের সেই চিত্র। অপরাধ করলেই চাকরি হারানোর পাশাপাশি শাস্তিও পাচ্ছেন অনেকে। তাই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে পুলিশে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কর্তৃক গণশুনানিতে ৪২টি সরকারি দফতরের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও এবার ছিল না পুলিশের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উদ্যোগে বদলে গেছে নগরের চিত্র। আমার গাড়ি নিরাপদ- অ্যাপসের মাধ্যমে নগরের সকল সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। যদি কেউ মূল্যবান জিনিসপত্র হারিয়ে ফেলেন বা গাড়িতে রেখে আসেন- অ্যাপসের মাধ্যমে খুঁজে বের করা যাচ্ছে মূহুর্তেই। আইজ অব সিএমপির মাধ্যমে পুরো চট্টগ্রাম নগরকে সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে। জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমনে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ভূমিকা ছিল প্রশসংশনীয়। প্রতিটি থানায় স্থাপন করা হয়েছে নারী-শিশু বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীদের জন্য হেল্প ডেস্ক। জনগণের কথা শুনতে প্রতিটি থানায় ওপেন হাউজ-ডে কর্মসূচি চলছে। সেখানে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেবা নিতে আসা লোকজনের অভিযোগ শুনে প্রতিকারের ব্যবস্থা করেন।
গত ১ জুলাই নগরের হামজারবাগ এলাকায় অস্ত্রসহ কিশোর গ্যাংয়ের একটি দল দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়। খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকে অস্ত্রসহ ঘটনাস্থল থেকে গ্রেফতার করেন পাঁচলাইশ থানা পুলিশের এসআই সোহেল। এছাড়া গত ৬ আগস্ট মাসুদ আলম (৩৭) নামের এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে দীর্ঘদিন ধরে চাঁদা দাবি করে আসছে চাঁদাবাজরা। বিষয়টি পুলিশকে জানালে তাৎক্ষণিক অভিযান চালিয়ে চাপাতিসহ ঘটনাস্থল থেকে দুইজনকে আটক করে পুলিশ। নগরের বায়জিদ থানাধীন বালুচড়া এলাকায় ছিনতাইয়ের শিকার হন মুকবল আহমদ নামের এক রিকশা চালক। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে অভিযান চালিয়ে হামলাকারীদের আটক করে পুলিশ। নগরের নিউমার্কেট এলাকার এক বাসিন্দা স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করতে আসেন। মামলা না নিয়ে উভয়পক্ষকে বুঝিয়ে এক সঙ্গে সংসার করার পরামর্শ দেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। এক মাস পর তারা নিজেরাই ওসির সঙ্গে ফুল নিয়ে দেখা করতে আসেন। পুলিশকে ধন্যবাদ জানান তারা। শুধু এ ঘটনাগুলোই নয়, পুলিশের ইতিবাচক কর্মকাণ্ড ইতিমধ্যে সাধারণ মানুষের কাছে সমাদৃত হয়েছে।
গত ৩ আগস্ট চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শহীদ বীর উত্তম শাহ আলম অডিটোরিয়ামে সকাল ৯টায় দুদকের গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় দুই বছর পর চট্টগ্রামে ৪২ সরকারি দফতরের বিরুদ্ধে আনা শতাধিক অভিযোগের বিষয়ে গণশুনানি করেছে দুদক। দুদক জানায়, নগরে অবস্থিত বিভিন্ন সরকারি দফতরের সেবা সহজ করা এবং হয়রানি বা দুর্নীতি বন্ধে এ গণশুনানির আয়োজন করা হয়েছে।
নগরের বিভিন্ন সরকারি দফতরের সেবাগ্রহীতাদের নিয়ে প্রথমবারের মতো এ গণশুনানির আয়োজন করা হয়। দুদক এবং মহানগর দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি এ গণশুনানির আয়োজন করে।
সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় বার্তা২৪.কম-কে বলেন, জনগণ পুলিশ সম্পর্কে কী ভাবে তা আমরা জানতে চাই। আমরা জনগণের কাছে হিরো হতে চাই, ভিলেন নয়। জনগণের কথা শুনতে প্রতিটি থানায় ওপেন হাউজ ডে কর্মসূচি চলছে। সেখানে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেবা নিতে আসা লোকজনের অভিযোগ শুনেন। প্রতিকারের ব্যবস্থা করেন। আমরা অভিযোগ শুনতে চাই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, পুলিশ হবে জনগণের পুলিশ, পুলিশ হবে জনগণের প্রকৃত বন্ধু। আর সেই জনগণের পুলিশ হওয়ার জন্যই আমরা কাজ করছি।
তিনি আরও বলেন, মাদক শুধু কোনও ব্যক্তিকে ধ্বংস করে না বরং গোটা সমাজকে বিপদগামী করে। তাই সমাজ এবং আগামী প্রজন্মকে বাঁচাতে দেশকে মাদকমুক্ত করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বাংলাদেশ পুলিশও জিরো টলারেন্স ঘোষণা দিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
গণশুনানিতে চট্টগ্রাম বন্দর, ওয়াসা, কাস্টমস, রেল, বিদ্যুৎ, পাসপোর্ট, ভূমি অধিগ্রহণ শাখাসহ সরকারি বিভিন্ন দফতরের ৪৭টি অভিযোগ তুলে ধরেন ভুক্তভোগীরা। গণশুনানি পরিচালনা করেন দুদকের মহাপরিচালক একেএম সোহেল। সিদ্ধান্ত দেন দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান।
গণশুনানিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মো. মোজাম্মেল হক খান বলেন, জিরো টলারেন্স টু করাপশান হচ্ছে আমাদের একমাত্র টার্গেট। এ লক্ষ্য অর্জন না করা পর্যন্ত আমাদের এ কার্যক্রম চলবে। দুদক এখন শুধু চুনোপুটিদের ধরছে না, রাঘব বোয়ালদের জেলহাজতে পুরে শাস্তি দিয়ে দুদকের সক্ষমতার জানান দিচ্ছে। দুদকের জালে একবার ধরাখেলে তার সম্পদ ভোগ করার সুযোগ থাকবে না এবং তার জীবন দশায় ভোগ করে যেতে পারবে না। রাষ্ট্রের বৈধ অধিকার ছাড়া কেউ যেন সম্পদ ভোগ করতে না পারে তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। সমাজ থেকে সমূলে দুর্নীতির মূল উৎপাটন করা হবে এটাই দুদকের অঙ্গীকার।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বার্তা২৪.কম-কে বলেন, পুলিশ এখন আর আগের অবস্থানে নেই। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ বর্তমান বাংলাদেশ পুলিশ এক নতুন মাত্রিকতায় জনগণের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। হাতেগোনা কয়েকজন পুলিশ বাহিনীর সদস্যের কারণে গোটা পুলিশ পরিবার কখনো কুলষিত হতে পারে না। বিশেষ করে করোনাকালীন সময়ে তাদের অবদান ছিল চোখে পড়ার মতো। এরপরও কিছু পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। সেগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলেই পুলিশ হবে জনতার।
তিনি আরও বলেন, জনগণের সঙ্গে আরও মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে পুলিশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ভীতি দূর করতে পুলিশকে কাজ করতে হবে। পুলিশ যাতে জনগণের পুলিশ হতে পারে, জনতার পুলিশ হতে পারে এবং জনবান্ধব পুলিশ হতে পারে, এ জন্য ‘মুজিব বর্ষের অঙ্গিকার, পুলিশ হবে জনতার' এ স্লোগানকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে। জঙ্গিবাদ কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ পুলিশ একটি মডেল।