ব্রিটিশ আভিজাত্যের চট্টগ্রাম ক্লাবে দেশি ঐতিহ্য নিষিদ্ধ!
ঐতিহ্যবাহী সংবাদপত্র দৈনিক আজাদীর প্রয়াত সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেককে একবার দরজা থেকে ফিরিয়ে দিয়েছিলো তারা। এই তারা হলো চট্টগ্রাম ক্লাব। যাদের পরিচিতি এশিয়ার প্রাচীনতম অভিজাত ক্লাব হিসেবে। তারা চট্টগ্রামের অন্যতম সংবাদ ব্যক্তিত্ব আবদুল খালেককে ক্লাবে ঢুকতে দেয়নি আভিজাত্য ভাঙবে না বলে। কারণ, খালেক সাহেবের পরনে নাকি পাঞ্জাবি ছিলো। এ পোশাক বাঙালির ঐতিহ্য হলেও ব্রিটিশ নিয়মে গড়া চট্টগ্রাম ক্লাবের ড্রেস কোডে নিষিদ্ধ। আজাদী সম্পাদক অবশ্য তার স্বকীয়তা বিসর্জন দেননি। আর কখনোই চট্টগ্রাম ক্লাবমুখী হননি তিনি।
তার মতো অনেকেই পাঞ্জাবি পরার কারণে ক্লাব গেট থেকে অপমানিত হয়ে ফিরে গেছেন। অভিযোগ রয়েছে, কয়েক বছর আগে প্রাইম ব্যাংকের একটি অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন দেশের স্বনামধন্য একটি শিল্প গ্রুপের চেয়ারম্যান। পাঞ্জাবি পরায় তাকেও ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের শীর্ষ কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছিলো। পাঞ্জাবি পরায় একজন ব্যবসায়ীকে সেখান থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিলো। বিষয়টি নিয়ে আয়োজক প্রতিষ্ঠান বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিল।
ট্রাস্ট ব্যাংকের চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান মিজানুর রহমান তখন বলেছিলেন, ভেন্যু ভাড়ার সময় আমাদের ড্রেসকোডের বিষয়ে বলা হয়নি। স্বাধীন দেশে ব্রিটিশদের গোলামি নিয়ম থাকা উচিত নয়; পরিবর্তন করা জরুরি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর আক্ষেপ আরও বড়। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম ক্লাব অনেকাংশে ভূমিদস্যু ও নষ্ট মাফিয়াদের দখলে। আমি আর যাই না সেখানে। এখন আমার সদস্যপদও নেই। ঘৃণা, প্রচণ্ড ঘৃণা তাদের প্রতি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্রিটিশ শাসনামলে সামাজিক ক্লাব হিসেবে ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম ক্লাবের প্রতিষ্ঠা। সামাজিক সংগঠন হিসেবে ইউরোপিয়ানরা এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ওই ক্লাবে ইউরোপিয়ানরাই কেবল সদস্য হতে পারতেন। ফলে তাদের সংস্কৃতি ও আচারঘনিষ্ঠ নিয়মই চলত। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশরা বিতাড়িত হলে পাকিস্তানিরা নিয়ন্ত্রণ নেয়; কিন্তু সেখানেও বাঙালিদের সদস্য হওয়ার সুযোগ ছিল না। নিয়ম-কানুনেও পরিবর্তন আনেনি। তারা কাবুলি পরার কারণে পাঞ্জাবিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের পোশাক মনে করত। ফলে তারাও বাঙালির ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার মূল্য দেয়নি।
ব্রিটিশদের বিতাড়ন এবং মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও ব্রিটিশদের কালো নিয়ম ও ভোগবাদী মনোভাব থেকে বের হতে পারেনি ক্লাবটি। বাঙালি সমাজ-সংস্কৃতি ও জীবনাচারকে উপেক্ষা করে এখনো লাটদের বানানো নিয়ম মানতে হয় ক্লাবের সদস্য ও আগত অতিথিদের, যা বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
ক্লাবের সদস্য এবং অতিথিদের নির্ধারিত ড্রেসকোড পরে ক্লাবে আসতে হয়। টি-শার্ট ও শার্টের সঙ্গে পরতে হবে ফরমাল সু বা ক্লাব নির্দেশিত স্যান্ডেল। তবে পাঞ্জাবি পরে প্রবেশ করতে পারবে না। ড্রেসকোড না মানলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।
ক্লাব সূত্রে জানা গেছে, মেমোরেন্ডাম অ্যান্ড আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশন অব চট্টগ্রাম ক্লাব লিমিটেড ও সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে ক্লাবের বাই-লজ অনুযায়ী ক্লাব পরিচালিত হয়। সেটাতে পরিবর্তন আনতে হলে ইজিএমের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে নির্বাচিত কমিটি বাই-লজে যে কোনো ধরনের পরিবর্তন বা সংশোধন আনতে পারে।
চট্টগ্রাম ক্লাবের সাবেক চেয়ারম্যান এমএ ছালাম বলেন, ক্লাবটি ব্রিটিশদের প্রতিষ্ঠিত। তাদের অনেক নিয়ম টেনে নিয়ে যাচ্ছি। ড্রেসকোডও সে রকম একটি। তবে চাইলে এ নিয়ম পরিবর্তন করা যায়। ঢাকা ক্লাব নিয়ম পরিবর্তন করে পাঞ্জাবি অ্যালাউ করেছে।
তবে ক্লাবের বর্তমান চেয়ারম্যান নাদের খান বলছেন, ড্রেসকোড থাকতেই পারে। ১৪৪ বছর আগে ব্রিটিশরা সামাজিক ক্লাবটি প্রতিষ্ঠা করেছিল। তাদের নিয়ম-কানুন এখনো চলছে। সন্ধ্যা ৭টার পরে ক্লাবে আসতে হলে ড্রেসকোড মানতেই হবে। মেমোরেন্ডাম অ্যান্ড আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশন এবং বাই-লজের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।
ক্লাবের সদস্য ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই নিয়ম বাতিল করা জরুরি। ড্রেসকোড থাকতেই পারে। কিন্তু বাঙালির সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক নিয়ম থাকা উচিত নয়। তাছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানকে অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া দেওয়ার পর ক্লাব ড্রেসকোড মানতে বাধ্য করতে পারে না। ব্রিটিশ আমলের অনেক আগে থেকেই পাঞ্জাবি বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পোশাক। বর্তমানেও বাঙালির অঘোষিত জাতীয় পোশাক পাঞ্জাবি। পহেলা বৈশাখ, ঈদ-পূজা, সামাজিক অনুষ্ঠান ও জানাজায় পাঞ্জাবি পরা হয়। এদেশের প্রধান পোশাক পরে ক্লাবে কেন যেতে পারবে না।
প্রসঙ্গত, গত জাতীয় শোক দিবসের আগে গত ১১ আগস্ট ভারতীয় শিল্পী এনে গানের জলসা আয়োজনের কর্মসূচি ঘোষণা করে সমালোচনার তোপে পড়ে চট্টগ্রাম ক্লাব। পরে বিভিন্ন মহলের আপত্তির মুখে সেই অনুষ্ঠান স্থগিত করতে বাধ্য হয়। এছাড়া ক্লাবটির মদের বার থেকে বিভিন্ন জায়গায় মদ সরবরাহের অভিযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে মদ খেয়ে ভ্যাট না দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে।