মাহেন্দ্রক্ষণ নির্ধারণ করা হয়েছে দুপুর ঠিক আড়াইটায়। তখনই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি হস্তান্তরের সার্টিফিকেট ও মডেল প্রদানের করা হবে।
তারপরেই (ভার্চুয়াল) কথা বলবেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আর সবার শেষে কথা বলবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের গ্রাজুয়েশনের এ আয়োজনে দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ভার্চুয়ালি যুক্ত হলেও সশরীরে থাকছেন দুই দেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা। এ জন্য প্রকল্প এলাকার বায়েক অফিস সংলগ্ন খোলা মাঠে বিশাল প্যান্ডেল বানানো হয়েছে। বৃষ্টি যাতে বাগড়া দিতে না পারে সেভাবেই এই প্যান্ডেলের ডিজাইন করা হয়েছে।
সামিয়ানার নিচে পাঁচ শতাধিক আসনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যেখানে বসে দুই রাষ্ট্রপ্রধানের ভার্চুয়াল বক্তব্য শোনা এবং দেখার ব্যবস্থা থাকছে।
বিশাল আয়তনের পরমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিভিন্ন পয়েন্টে পয়েন্টে বসানো হয়েছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের ছবি। রয়েছে বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিও। সঙ্গে স্বারক হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ চুক্তির ছবিও।
পুরো বিদ্যুৎ কেন্দ্র এলাকায় নানা রঙের ব্যানার ফেস্টুন দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। বাদ যায়নি মূল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাইরে মহাসড়কও। সব মিলিয়ে সাজ সাজ বর চলছে প্রকল্প এলাকায়। সফল পরিণতিতে খুশির আমেজ বিরাজ করছে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে।
দেড়টার মধ্যে আমন্ত্রিত অতিথিদের আসন গ্রহণের জন্য সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। দুপুর ২ টায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। শুরুতেই প্রকল্পের পরিচিতি তুলে ধরবেন পরমাণু বিজ্ঞানী ও প্রকল্প পরিচালক ড. মো. শৌকত আকবর।
এরপরেই থাকছে পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদন ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রথম ব্যাচের হস্তান্তর সম্পর্কিত ভিডিও প্রদর্শন।
আনুষ্ঠানিক বক্তৃতা পর্বে শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখবেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ আলী হোসেন। এরপর ভার্চুয়াল সংযুক্ত থেকে বক্তৃতা করবেন আন্তর্জাতিক আনবিক শক্তি কমিশন (আইএইএ) মহাপরিচালক রাফায়েল মারিয়ানো গ্রসি। বক্তৃতা করবেন রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রোসাটমের মহাপরিচালক আলেক্সি লিখাচেভ।
সভাপতির বক্তব্য রাখবেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান। মন্ত্রীর বক্তব্যের শেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ
পারমাণবিক জ্বালানি হস্তান্তরের সার্টিফিকেট ও মডেল প্রদান। অনুষ্ঠান সূচিতে ২.২৯ টায় রাখা হয়েছে মডেল হস্তান্তর কার্যক্রম।
রাশিয়ার পক্ষ থেকে রোসাটমের মহাপরিচালক আলেক্সি লিখাচেভ বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের হাতে সার্টিফিকেট ও মডেল তুলে দেবেন। এরপর দুপুর ২.৪৪ টায় বক্তব্য রাখার কথা রয়েছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সবশেষে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
একদিন আগেই বুধবার (৪ অক্টোবর) গ্রাজুয়েশন অনুষ্ঠানের সার্বিক প্রস্তুতি পরিদর্শন করেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান।
তিনি বলেন, আমরা বলতে পারি রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাংলাদেশের চিত্র বদলে দেবে। বাংলাদেশ যে পারে সেটি আবারও প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। এটি জিডিপিতে ২ শতাংশ অবদান রাখবে। এরমধ্যদিয়ে নিউক্লিয়ার ক্লাবের ৩৩ সদস্য গর্বিত সদস্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানির নাম ইউরেনিয়াম। বিশ্বের শক্তিশালী পদার্থের অপর নামও ইউরেনিয়াম। এটি দিয়ে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেমন ভয়ংকর পরমাণু বোমা তৈরি যায়, তেমনি বিশ্বব্যাপী পরিবেশবান্ধব জ্বালানি হিসেবেও বহুল প্রচলিত।
তেল, গ্যাস কিংবা কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে তাতে কমবেশি কার্বন নিঃসরণ অবধারিত। তবে পরমাণু বিদ্যুতে সেই দুষণ প্রায় শূন্যের কোঠায়। বর্তমানে পৃথিবীর ৩০টি দেশে ৪৪৯টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। সেগুলো থেকেউৎপন্ন বিদ্যুতের পরিমাণ মোট উৎপন্ন বিদ্যুতের প্রায় ১২ শতাংশ। ১৪টি দেশে আরও ৬৫টি পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে।
২০২৫ সাল নাগাদ ২৭টি দেশে ১৭৩টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়া চলমান।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ইউরেনিয়াম বিক্রিয়ায় তাপ উৎপন্ন করা হয়। সেই তাপ থেকে জলীয় বাষ্পের সহায়তায় জেনারেটর ঘুরিয়ে সৃষ্টি হয় বিদ্যুৎ। এক কেজি ইউরেনিয়াম প্রায় ১০০ টন কয়লার সমান তাপ উৎপাদনে সক্ষম। আর একই পরিমান তাপ তেলে উৎপাদন করতে হলে ৬০ টন ডিজেল প্রয়োজন হবে। যে কারনে সহজে পরিবহনযোগ্য বিবেচনা করা হয়।
এই জ্বালানি একবার লোড করে নিরবিচ্ছিন্নভাবে ১৮ মাস বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে।একই পরিমান বিদ্যুৎ অন্য জ্বালানিতে পেতে হলে অনবরত সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হয়। পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব হিসেবে পরিচিত এই বিদ্যুৎ।
রূপপুরের দুটি ইউনিট থেকে ১ হাজার ২ শ মেগাওয়াট করে ২ হাজার ৪শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। চুক্তি অনুযায়ী রূপপুরের লাইফটাইমে (৮০ বছর) এটি সরবরাহ করবে রাশিয়া। তবে প্রথম তিন বছর এই জ্বালানি বিনামূল্যে সরবরাহ করবে দেশটি।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নকশা অনুযায়ী পুরো মেয়াদেই জ্বালানি আনতে হবে রাশিয়া থেকে। এজন্য অন্য আরেকটি চুক্তির মাধ্যমে ইউরেনিয়ামে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে প্রথম তিন বছরে যে জ্বালানি আসবে তার আনুমানিক মূল্য প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। প্রথম পর্যায়ে একটি ইউনিটে ১৬৩টি ইউরেনিয়াম বান্ডিল সংযোজন বা লোড করতে হবে।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর কঠোর নিরাপত্তার মধ্যদিয়ে রূপপুরে নেওয়া হয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জ্বালানি ইউরেনিয়াম রড। এর আগে রাশিয়ার একটি কারখানা থেকে একটি বিশেষ বিমানে করে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পারমাণবিক জ্বালানির এই চালান আনা হয়। রাশিয়ার নভোসিবিরস্ক কেমিক্যাল কনসেনট্রেটস প্ল্যান্টে (এনসিসিপি) ওই জ্বালানি উৎপাদিত হয়।