অক্সিজেন স্বল্পতায় ভালুকায় ৩ শ্রমিকের মৃত্যু, অসুস্থ অর্ধশতাধিক
ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার জামিরদিয়া এসকিউ গ্রুপের বিরিকিনা এবং সেলসিয়াস কারখানায় শ্রমিক কর্মকর্তাসহ তিনজনের মৃত্যু এবং অর্ধশতাধিকের বেশি শ্রমিক অসুস্থ হওয়ার ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির দুটি কারখানা সাময়িক বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন।
রোববার (২১ জানুয়ারি) রাত সাড়ে ৯ টার দিকে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর ময়মনসিংহের উপ-মহাপরিদর্শক মো. আরিফুজ্জামান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
সূত্র জানায়, ভালুকার জামিরদিয়া মাস্টারবাড়ি এলাকার এসকিউ গ্রুপের চারটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসকিউ গ্রুপের এসব গার্মেন্টসে অন্তত ১৬ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। গত ১০ জানুয়ারি কারখানার বিরিকিনি ইউনিটে কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে নার্গিস আক্তার ও ১২ জানুয়ারি রিফাত হাসানসহ দু’জনের মৃত্যু হয়। নার্গিসের বাড়ি ভালুকার বিরুনিয়া ইউনিয়নের কায়চান গ্রামে। রিফাতের বাড়ি চট্টগ্রামে। ১৩ জানুয়ারি অসুস্থ হন আরও ৪৩ শ্রমিক।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে দু’দিন বন্ধ রাখার পর মঙ্গলবার কারখানা চালুর দুই ঘণ্টার মধ্যেই এসকিউ সেলসিয়াস ইউনিটে আটজন অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে শিউলি আক্তারকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান।
এদিকে, গত শনিবার এসকিউ সেলসিয়াস শাখায় অঞ্জনা ও কুলসুম নামে আরও দু'জন অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে তাদের কারখানার পিছনের দরজা দিয়ে ভালুকা উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি করেন। সেখানে চিকিৎসা নেয়ার পর বিকালের দিকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে চলে চলে যান। এদিন, পুলিশকে কারখানার ভিতরে ঢুকতে না দেয়ার অভিযোগ উঠে। এসকিউ গ্রুপের দুই শাখায় মোট ৫৩ জন অসুস্থ হয়েছেন। তাদের মাঝে তিনজন মারা গেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নার্গিস ও রিফাতের মৃত্যুর পর কারখানা কর্তৃপক্ষ তড়িঘড়ি করে মরদেহ দুটি তাদের পরিবারকে বুঝিয়ে দেয়। এখানে নির্ণয় করা হয়নি মৃত্যুর কারণ। তবে মঙ্গলবার শিউলি মারা যাওয়ার পর তার মরদেহ ময়নাতদন্ত করা হয়। সন্ধ্যায় পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয় মরদেহটি। শিউলি এসকিউ সেলসিয়াসে অপারেটর পদে কাজ করতেন। তার বাড়ি নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলার রবিয়াগাতি গ্রামে। রাতেই বাবার বাড়ির কবরস্থানে দাফন করা হয় তার মরদেহ।
নিহতের স্বজনরা বলছে, এসব ঘটনায় কারখানা কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণেই ঘটছে। যে কারণে নিরপেক্ষ তদন্ত হচ্ছে না। তদন্ত করে মুত্যুর কারণ খুঁজে বের করে এসব ঘটনার বিচার দাবি করেন তারা।
অসুস্থ হয়ে পড়া শ্রমিক হাছিনা আক্তার বিরিকিনির সুইং সেকশনে দেড় মাস ধরে কাজ করেন। তিনি বলেন, 'ঘটনার দিন সকাল পৌনে ৮টার দিকে কারখানায় যাই। সুস্থ অবস্থায় কাজে যোগ দিয়ে ঘণ্টা দুইয়ের মধ্যে হঠাৎ হাত-পা কেঁপে অচেতন হয়ে পড়ি। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পর অনেকক্ষণ অক্সিজেন দিলে চেতনা ফিরে আসে।' কারখানায় কাজ করতে গিয়ে শ্রমিকদের মৃত্যুর পর আতঙ্ক বিরাজ শ্রমিকদের মাঝে।
সূত্র জানায়, এসব ঘটনায় ১৩ জানুয়ারি সাত সদস্যের কমিটি গঠন করে জেলা প্রশাসন। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসানকে প্রধান করে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর ময়মনসিংহের উপমহাপরিদর্শক মো. আরিফুজ্জামানকে সদস্য সচিব করে কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। একই দিন শিল্প পুলিশের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। শিল্প পুলিশের ভালুকা অঞ্চলের সহকারি পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলমকে ওই কমিটির প্রধান করে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। গত মঙ্গলবার আরেক শ্রমিকের মৃত্যুর পর জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে সিভিল সার্জন তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। এসব তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ইতিমধ্যে জমা পড়েছে।
এ বিষয়ে এসকিউ গ্রুপের এডমিন আসাদের নাম্বারে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেনি।
ভালুকা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসানুল হোসাইন বলেন, 'গত শনিবার এসকিউ গ্রুপের কারখানায় দুই শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে তাদের ভর্তি করা হলে চিকিৎসা নিয়ে বিকাল ৪ টার দিকে চলে গেছে। শ্বাস কষ্ট হলে অন্য যে উপসর্গগুলো দেখা যায়। যে দু'জন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল, তাদের মাঝে সেই উপসর্গ দেখা যায়নি। দু'জনের মধ্যে ১ জন আগে থেকেই শ্বাসকষ্টের রোগী ছিল' ।
তিনি আরও বলেন, 'নিহত তিন জন বিভিন্ন সময় মারা গেছে। আমরা চিকিৎসকদের সাথে কথা বলে জানতে পারি যে, এর মধ্যে ১০ জানুয়ারী নার্গিস আক্তার নামে এক শ্রমিক মস্তিস্কে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে (স্ট্রোক) মারা গেছে। দ্বিতীয় জন রিফাত হাসান বুকে ব্যাথা হওয়ার পর হাসপাতালে আনা হলে ইসিজি করা হয়। ইসিজির রিপোর্টে দেখা গেছে। সে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন।'
তৃতীয় জন শিউলি আক্তার। তিনি হৃদরোগ, থাইরয়েড এবং শ্বাসতন্ত্রের রোগী ছিলেন। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যায়। তার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উদঘাটনের জন্য সিভিল সার্জনের সাথে কথা বলে ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলে এখন আসেনি। আসলে প্রকৃত কারণ বলা যাবে।
অসুস্থ হচ্ছে এটার মূল কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকের হৃদরোগের রোগী, হাঁপানির সমস্যা আছে এরা যে কোন সময়ই অসুস্থ হতে পারে। হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া খিঁচুনির মত হয়ে যাওয়া, এগুলোর কোন কারণ আসলে নাই। তবে আমরা যেটা সন্দেহ করছি শ্রমিকদের ভিতরে বিভিন্ন ধরনের গুজব বা ভয় কাজ করছে।'
'পরপর তিনজন মারা যাওয়ার এবং একজন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় মারা ব্যক্তির চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে। তার একটা ছবি অনেকে দেখছে, এই কারণে তাদের মনে ভিতরে একটা আতঙ্ক সবসময়ই চলে। এটা থেকে তাদের রোগের লক্ষণগুলো আসে। আমরা এটাকে গণমনস্তাত্ত্বিক সমস্যা বলি।'
ভালুকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এরশাদুল আলম বলেন, '১ জন সড়ক দুর্ঘটনায় এবং তিন জন ভিন্ন ভিন্ন রোগে মারা গেছেন। তদন্ত কমিটি রিপোর্ট অনুযায়ী অক্সিজেন স্বল্পতা একটা ফ্যাক্টর, আরেকটা ফ্যাক্টর হলো পাশের ইটিবি প্লান্ট এবং অক্সিজেন ও আলো বাতাস। যে সব পয়েন্ট দিয়ে প্রবেশে করে। সেই বিষয় গুলো অবজারভেশনে নেওয়া হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'কারখানা কতৃপক্ষ চিঠি দিয়ে তিন দিন আগে দুইটি সেকশন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর এবং ডিসি অফিসের সম্মনয়ে একটি তদন্ত কমিটি তদন্ত করে রিপোর্ট জমা দিয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।'
ময়মনসিংহ শিল্পপুলিশ-৫ এর পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মিজানুর রহমান বলেন, 'গতকাল শনিবার দু'জন অসুস্থ হয়েছে বলে জানতে পেরেছি। এখানে আমাদের দায়িত্ব হলো শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা। এর চাইতে বেশি কিছু বলতে পারব না।'
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ জেলা সিভিল সার্জন ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, 'গত শনিবার দু'জন অসুস্থ হওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। জেলা প্রশাসন ও আমরা পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলাম। ইতিমধ্যে, তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসন ও আমাদের তদন্ত প্রতিবেদনের ফলাফল একই রকম এসেছে।'
ময়মনসিংহের উপ-মহাপরিদর্শক মো. আরিফুজ্জামান বলেন, 'এ ঘটনায় সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তদন্তে দেখা গেছে, কিছুদিন ধরে কারখানার ৬ষ্ঠ তলার শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও এগজস্ট ফ্যান বন্ধ রাখা এবং কারখানার পাশেই ইটিপি স্থাপন করার ফলে সেখান থেকে নির্গত ক্ষতিকারক গ্যাস (মিথেন, কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, হাইড্রোজেন সালফাইড, অ্যামোনিয়াম ভেতরে প্রবেশ করে। বায়ু প্রবাহে ত্রুটি থাকার কারণে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় অক্সিজেন স্বল্পতায় শ্বাসরোধ হয়ে শ্রমিক কর্মকর্তাসহ ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়েছে।'
সেই সঙ্গে অসুস্থ শ্রমিক কর্মকর্তাদের দায়সারা চিকিৎসা এবং সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব অবহেলার বিষয়টিও প্রতীয়মান হয়েছে। এই অবস্থায় তদন্ত প্রতিবেদনে এই প্রতিষ্ঠানটিকে ছয় দফা সুপারিশ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।