দখলে বিপন্ন জলাভূমি

  • স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

মানবসভ্যতা, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার প্রধান মাধ্যম হলো পানি বা জলাভূমি। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীনালা, খাল-বিল, হাওরের মতো বহু জলাভূমি ঘিরে রেখেছে। বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে, দেশের ৭ থেকে ৮ লাখ হেক্টর ভূমি কোনো না কোনোভাবে জলাভূমির অন্তর্ভুক্ত। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জীববৈচিত্র্য, কৃষি, মৎস্য, পর্যটনসহ নানা ক্ষেত্রে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো জলাভূমি।

দিনদিন কমতে শুরু করেছে জলাভূমি। নদীনালা, খাল-বিল, হাওর দখল করে গড়ে উঠছে স্থাপনা। জলাভূমি ভরাট করে গড়ে উঠছে বাসস্থান, কলকারখানা। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে তাই হুমকির মুখে পরিবেশ। একটি বাসযোগ্য শহরে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ জলাভূমি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকায় রয়েছে ২.৯ শতাংশ। পুকুর ও জলাশয় কমে গেলে নগরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় হারিয়ে যেতে বসেছে পানির উৎস—জলাভূমি।

বিজ্ঞাপন

জানা যায়, ১৯৯৬ সালের পর থেকে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় জলাভূমির পরিমাণ কমে তা এখন দাঁড়িয়েছে ৭ ভাগের ১ ভাগে। ১৯৯৫ সালে ঢাকার সাড়ে ২০ শতাংশ জায়গাজুড়ে ছিল জলাশয়ের পরিধি। ২০২৩ সালে এসে তা ৩ শতাংশের নিচে নেমেছে। হাওর এলাকায় গত তিন দশকে ৮৭ শতাংশ জলাভূমি কমে ৪০০ বর্গকিলোমিটারে নেমেছে।

দেশে জলাধারের এই পরিস্থিতিতে শুক্রবার (২ ফেব্রুয়ারি) বিশ্ব জলাভূমি দিবস পালিত হচ্ছে। ১৯৯৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি থেকে ১০০টিরও বেশি দেশের পরিবেশসচেতন নাগরিকরা এই দিবসটি পালন করে আসছে।

বিজ্ঞাপন

জলাভূমির অপরিসীম গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৯৭১ সালের এই দিনে ইরানের রামসার শহরে পরিবেশবাদী সম্মেলনে জলাভূমির টেকসই ব্যবহার ও সংরক্ষণের জন্য একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি সই হয়। যা রামসার কনভেনশন চুক্তি বলে পরিচিত। ১৯৭৫ সালে রামসার কনভেনশন চুক্তি কার্যকর হয়। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ এ চুক্তিতে সই করে। ওই বছরের ২১ মে বাংলাদেশের ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনকে এবং ২০০০ সালের ২৯ জানুয়ারি টাঙ্গুয়ার হাওরকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ‘রামসার সাইট’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৯৫ সালে রাজধানী ঢাকায় জলাভূমি ছিল ২০ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ২০০৫ সালে ৮ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ, ২০১৫ সালে ৩ দশমিক ২১ শতাংশ এবং ২০২৩ সালে তা কমে দাঁড়ায় ২ দশমিক ৯১ শতাংশে।

মৎস্য বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৮৫ সালে ঢাকায় পুকুর ছিল দুই হাজার। ফায়ার সার্ভিসের তথ্যে ২০১৮ সালে রাজধানীতে ১০০টি পুকুরের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, যা ২০২৩ সালে কমে ২৯টিতে দাঁড়িয়েছে। গত পাঁচ বছরে ঢাকায় পুকুর কমেছে ৭১টি।

ভূমি অঞ্চল সংরক্ষণের জন্য অনুমোদিত নির্দেশিকা না মেনে চলা, উন্নয়নের জন্য জলাভূমি ভরাট করে প্রতিনিয়ত আবাসিক বা বাণিজ্যিক ভবন তৈরি ও ড্যাপে বর্ণিত টিডিআর পলিসির যথাযথ বাস্তবায়ন না করাকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা।

রিভার এন্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) গবেষণায় বলা হয়, উন্নয়ন প্রকল্পের নামে জলাশয় ভরাট ও সবুজ এলাকা নিধন, ভূমি ব্যবহারের ক্ষেত্রে জলাশয় সংরক্ষণ আইন সম্পর্কে সাধারণ ও সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তাদের অজ্ঞতা ও অসচেতনতা, আইনি জটিলতা ও স্থানীয় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, আইনি কাঠামোর দুর্বলতা, আইন বাস্তবায়নে অবহেলা ও দুর্নীতি, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের খালের সাথে জলাশয়গুলোর ব্যবস্থাপনা বুঝে না নেওয়া, রাজউকের সমন্বয়ের অভাব, সরকারিভাবে জলাশয়ের কোন তালিকা প্রকাশ না করার ফলে জলাভূমি বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

রিভার এন্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, উন্নয়নের ক্ষেত্রে জলাধার বা জলাশয়কে সম্মুখে রেখে উন্নয়ন করতে হবে। জলাশয়গুলো বর্ষা মৌসুমে এলাকার জলাবদ্ধতা থেকে নগরকে রক্ষা করে। পুকুর ও জলাশয় ধ্বংসের কারণে ঢাকায় জলাবদ্ধতাসহ নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হচ্ছে। এভাবে পুকুর, জলাশয় ভরাট হতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আরও নিচে নেমে যাবে। এছাড়া দেখা দেবে মিঠা পানির সংকট। নিজেদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই এসব পুকুর ও জলাধার আমাদের রক্ষা করতে হবে।