জিম্মি নাবিক নাজমুলের পরিবারে নেই ঈদ আনন্দ

  • ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিরাজগঞ্জ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

জিম্মি নাবিক নাজমুলের পরিবারে নেই ঈদ আনন্দ

জিম্মি নাবিক নাজমুলের পরিবারে নেই ঈদ আনন্দ

আর মাত্র তিনদিন পরই ঈদুল ফিতর। ঈদকে সামনে রেখে নাজমুলের পরিবারে হচ্ছে না কোনো ধরনের কেনাকাটা বা আনন্দ। ভারতীয় মহাসাগরে সোমালিয়া জলসদ্যুদের হাতে জিম্মি নাবিক নাজমুল হকের পরিবারের সবাই তার ফিরে আসার অপেক্ষায় প্রহর গুণছেন।

রোববার (৭ এপ্রিল) সকালে নাজমুল হকের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অন্যবারের ঈদগুলো হাসি-খুশির থাকলেও এবার ঈদ তাদের কাছে নীরব কান্নার। একইসঙ্গে বয়ে বেড়াচ্ছে শঙ্কা ও প্রতীক্ষা।

বিজ্ঞাপন

পরিবারের উপার্জনশীল ব্যক্তির বন্দিদশায় মহাসাগরে তলিয়ে গেছে তাদের ঈদ আনন্দ। প্রধানমন্ত্রীর কাছে ঈদুল ফিতরের আগেই ২৩ নাবিকের মুক্তির আকুতি জানিয়েছেন নাজমুলের স্বজনরা।

জলদস্যুদের হাতে জিম্মি সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার ভদ্রঘাট ইউনিয়নের প্রত্যন্ত চর-নূরনগর গ্রামের আবু শ্যামা ও নার্গিস দম্পতির একমাত্র ছেলে নাজমুল হক।

বিজ্ঞাপন

প্রতিবেশী ও স্বজনরা জানান, নাজমুল হকের বয়স মাত্র (২৩) বছর। দুই ভাই-বোনের মধ্যে তিনি বড়। ছোটবেলাতেই মারা গেছে তার তিন ভাই-বোন। মাত্র ২০ বছর বয়সেই জাহাজে চাকরি পাওয়ার সুবাদে পরিবারের মুখে ফুটিয়েছে হাসি ও খুশির আনন্দ। কিন্তু গত ১২ মার্চ সোমালিয়া জলদস্যুদের অপহৃত হওয়ার পর থেকেই ছেলের মুক্তির সংবাদের প্রতীক্ষায় সময় পার করছেন নাজমুলের মা-বাবাসহ পরিবারের সদস্যরা। তাদের সন্তান ফিরে পেতে আল্লাহর দরবারে নামাজ, রোজা ও দোয়া করে সময় পার করছেন তারা। দিন-রাত ছেলের ছবি এবং মোবাইলে কোনো সংবাদ এলো কিনা তা দেখছেন তারা। প্রতীক্ষার প্রহর যেন তাদের শেষ হতে চাইছে না। অপহৃতের পর থেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বৃদ্ধ নাজমুলের বাবা। কান্না ও আহাজারিতে রাত-দিন পার হচ্ছে মা নার্গিস ও বোন নাজমার।

স্বজনরা আরও জানান, প্রতিবছর ঈদের কেনাকাটা করলেও এবার কিছুই হয়নি তাদের। ছেলের সুস্থতা আর নিরাপদে ফিরে আসার অপেক্ষা করছে তার বাবা-মা। দস্যুরা কথায় কথায় মাথায় বন্দুক ধরে, জাহাজে খাবার সংকট, পানি সংকট এমন নানা দুশ্চিন্তায় আরও ভেঙে পড়েছেন তারা। প্রশাসনসহ অনেকেই তাদের খোঁজখবর নিতে আসে। শুধু সান্ত্বনা দিয়েই যায়। সন্তানের ভালো সংবাদের অপেক্ষা আর শেষ হয় না তাদের। আমরা চাই সরকার ২৩ জন নাবিককে ঈদের আগে ফিরিয়ে আনবে এমন প্রত্যাশা আমাদের।


একই কোম্পানিতে নাবিক পদে চাকরি পাওয়া নাজমুলের ফুফাতো ভাই আল-মাহমুদ বলেন, এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজটি জিম্মির বিষয়টি সবার আগে অফিসের গ্রুপের মাধ্যমে আমি জেনেছি। গ্রুপে আসা তাদের জাহাজের ভিডিও দেখেই বুঝতে পারি এটা নাজমুলদের জাহাজ। আমি জানলেও তার পরিবারকে বিষয়টি আগেই জানাইনি। পরের দিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে নাজমুলের সঙ্গে আমার সর্বশেষ যোগাযোগ হয়। তখন পর্যন্ত বলেছে যে ভালো আছে ও খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো দিয়েছে। তবে গত ২৩ দিন বন্দিদশায় বদলে গেছে নাজমুলের পরিবারের চিত্র। ঈদের আগেই যেন আমার ভাইসহ সব নাবিকদের মুক্তির ব্যবস্থা করে সরকার। তারা যেন সবাই ভালোভাবে ফিরে আসে পরিবারের কাছে। এই দোয়াই করি সব সময়।

নাজমুলের প্রতিবেশী শাকিল শেখ ও আমিরুল ইসলাম বলেন, নাজমুল খুবই ভদ্র ও ভালো ছেলে। এখানে পড়াশোনা করা অবস্থাতেই চাকরি হয়ে গেছে। নাজমুল ছাড়া ওদের পরিবারকে দেখার আর কেউ নেই। এর আগে ছোটবেলাতেই নাজমুলের আরও তিন ভাই-বোন মারা গেছে। এখন তার একটা বোন আছে, তারও বিয়ে হয়ে গেছে।

স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুস সাত্তার বলেন, দরিদ্র পরিবারের সন্তান জাহাজে চাকরি পাওয়ায় আমরা অনেক খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু জলদস্যূদের হাতে নাজমুলের জিম্মি হওয়ার খবর শুনে আমরাও খুব ভেঙে পড়েছি ও এলাকাবাসী অনেক কষ্ট পেয়েছে। সুস্থতার সঙ্গে দ্রুত নাজমুলসহ সবাইকে সন্তান তাদের মা-বাবার বুকে ফিরিয়ে আনার জোড় দাবি জানিয়েছেন সরকারের কাছে।

নাজমুলের মা নার্গিস বেগম বলেন, নাজমুলের আয়েই আমাদের সংসার চলে। মাসে ৯০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পাঠাতো। জিম্মি হওয়ার আগের মাসে ৯১ হাজার টাকা দিয়েছে সন্তান। আমার ছেলেটা এখনো বিয়ে করেনি। নাজমুল অনার্সে ভর্তির পরেই চাকরি হয়েছে। চাকরি হওয়ার পরে প্রথমে গিয়ে ৩ বছর ছিলো। এরপর এসে আবার মাস তিনেক হলো গেছে। ঢাকা থেকে বিমানে দক্ষিণ কোরিয়া গিয়ে ওখান থেকে জাহাজে উঠেছে নাজমুল।

নার্গিস আরও বলেন, যখন তারা জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হয় তখন আমার বুকের মানিক বলেছিল মা ২০ থেকে ২৫ দিনের খাবার আছে, আর ২০০ মেট্রিক টন পানি আছে। দস্যুরা কথায় কথায় মাথায় বন্দুক ধরে রাখে, জাহাজে খাবার সংকট, পানি সংকট এমন নানা দুশ্চিন্তায় আমার ঘুম আসে না। এতদিন কী খাবার আছে? এ সময় তিনি ছেলেকে ঈদের আগে ফিরে পেতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দ্রুত মুক্তির দাবি করেন।

কামারখন্দ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শহীদুল্লাহ সবুজ বলেন, বিষয়টি শোনার পরেই নাজমুলের পরিবারের কাছে গিয়েছিলাম। তাদেরকে বলেছি আপনারা বিশ্বাস রাখুন সরকার দ্রুত আপনাদের ছেলেসহ সব বন্দিদশাদের ফিরিয়ে আনবে ইনশাল্লাহ।

এ ব্যাপারে কামারখন্দ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শাহীন সুলতানা বলেন, জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ার পর থেকেই জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে তাদের পরিবারের সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছি। অপহৃত নাবিকদের উদ্ধারের বিষয়টি নিয়ে সরকার ও জাহাজ মালিকের পক্ষ থেকে সব ধরনের চেষ্টা চলছে। পরিবারের একমাত্র ছেলে নিখোঁজ থাকলে তাদের তো আসলে ঈদ বলতে কিছুই থাকে না। তারপর আমরা তাদের পাশে আছি। আমরা নাজমুলের পরিবারকে দ্রুত সহযোগিতা করব।