কালিদাস পাহালিয়া নদীতে ভাঙন রোধে পদক্ষেপ না নেওয়ার অভিযোগ

  • মোস্তাফিজ মুরাদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ফেনী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

পাহালিয়া নদীর ভাঙন, ছবি: বার্তা২৪.কম

পাহালিয়া নদীর ভাঙন, ছবি: বার্তা২৪.কম

সম্প্রতি শতাব্দীয় ভয়াবহ বন্যার পানি নেমে গেলে ফেনী সদরের কালিদাস পাহালিয়া নদীর ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছিলেন জেলা প্রশাসক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) শীর্ষ কর্মকর্তারা। পরিদর্শনের এক মাস হয়ে গেলেও ভাঙন রোধে নদী তীরবর্তী অঞ্চলে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করে বলেন, কালিদাস পাহলিয়া নদীর আগ্রাসী ভাঙনে প্রতিদিন কোনো না কোনো স্থানে বিলীন হচ্ছে বসতি। তবে শুধু পরিদর্শনেই সীমাবদ্ধ রয়েছে ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের কার্যক্রম। ভাঙন রোধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

বিজ্ঞাপন

কেবল ফেনী সদরের লেমুয়া ও ছনুয়া ইউনিয়ন নয়, এর প্রভাব গিয়ে পড়েছে সোনাগাজীর নবাবপুরে ইউনিয়নের নদী তীরবর্তী লোকালয়ে। ইতোমধ্যে ভাঙন আতঙ্কে ওইসব অঞ্চলে ভিটেমাটি হারানোর শঙ্কায় দিন কাটছে মানুষের। এ বিষয়ে এর আগে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বার্তা২৪.কম।

লেমুয়া ও ছনুয়ার নদীতীরের মানুষরা জানান, গত ৩ সেপ্টেম্বর ছনুয়া ইউনিয়নের টঙ্গিরপাড়া ও লেমুয়ায় নদী ভাঙন স্থান পরিদর্শন করেন জেলা প্রশাসক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা। কিন্তু এরপর ভাঙন রোধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। এর মধ্যেই নদী ভাঙনের তীব্র আগ্রাসনে কৃষিজমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে লেমুয়া বেইলি ব্রিজের পশ্চিম পাশে, সওদাগর পাড়া, নেয়ামতপুর এলাকায় নদী ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে।

এ বিষয়ে লেমুয়া ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি শাহ আলম বলেন, ভাঙন রোধে ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় নেয়ামতপুরের পর নতুন করে কাজী বাড়ি, মহিন উদ্দিন বাড়ি ও জলদাস পাড়ায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। দ্রুতই ভাঙন রোধ করা না গেলে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে কয়েকটি গ্রামসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।


চাঁদপুর আদর্শ সমাজের সাধারণ সম্পাদক আলী মনসুর সুমন বলেন, লেমুয়া বেইলি ব্রিজের পূর্ব ও পশ্চিম পাশে নদীভাঙন তীব্রতর হচ্ছে। জেলা প্রশাসক পরিদর্শনের পর স্থানীয় কামাল, টিটু, মুসা ও আবদুল শুক্কুর অনেকের বসতর ঘরের কিছু অংশ ও পূর্বপাড়ে কয়েকজনের ঘর নদীতে ভেঙে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা পরিদর্শনের সময় লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। একাধিক বার অফিসে গেলেও এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি পাউবো।

সুমন আরও বলেন, লেমুয়া বেইলি ব্রিজের পশ্চিম পাশে ২৫-৩০টি পরিবার বসবাস করে। এদের মধ্যে অনেকে রিকশাচলক ও দিনমজুর। সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এখনও ক্ষতিগ্রস্তদের কোনো তালিকা তৈরি করেন নি।

ভাঙনে টঙ্গিরপাড়ার ক্ষতিগ্রস্ত মোঃ ওমর ফারুক বলেন, জেলা প্রশাসক পরিদর্শনের পর পেশকার বাড়ির দুলাল হোসেন, পারভেজ, শাহজাহান, মিয়া, রস্তুম আলী ও বলী বাড়ির আবুল বশরসহ অনেকের বসতর ঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। আমাদের মসজিদ, মক্তব, কবরস্থান ও খেলার মাঠ সব নদীতে চলে গেছে। এখন ঘর ভিটা ছাড়া কিছু নেই।

শুধু স্থানীয় এলাকা নয়, ভাঙনে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের লেমুয়া ব্রিজ ও বাজারও ঝুঁকিতে রয়েছে। স্থানীয় এলাকাবাসী দাবি করেন, নদী ভাঙন রোধ করতে হলে নদীতে জেগে ওঠা চর ও পলিমাটি অপসারণ করতে হবে। লেমুয়া ব্রিজের পাশে বালু মহাল উচ্ছেদ করতে হবে। বালু উত্তোলনের কারণে নদী ভাঙন আরও তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে।

ভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে স্থানীয় মানুষরা। লেমুয়া বেইলি ব্রিজের সংলগ্ন নদীর পাড়ের বাসিন্দা মো. কামাল উদ্দিন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ঋণ করে ঘরটি নির্মাণ করে দুই ভাই বসবাস করছি। যেভাবে নদী ভাঙতে শুরু করেছে আমরা এখন কোথায় যাব। আমাদের মতো গরীব মানুষগুলো নিঃস্ব হয়ে যাবে।

আরেক ক্ষতিগ্রস্ত টিটু জানান, নদীর পশ্চিম পাড়ে লেমুয়া বেইলি ব্রিজ সংলগ্ন স্থানে ৩০ পরিবার বসবাস করে। যেভাবে ভাঙন শুরু হয়েছে, এতে পরিবারগুলো অসহায় পড়ে পড়ছে।

লেমুয়া ইসলামিয়া দাখির মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত সুপার আনোয়ার হোসেন জানান, বালু উত্তোলনের কারণে এ ভাঙন হচ্ছে। ঘরগুলো রক্ষা করতে দ্রুত জিও ব্যাগ ফেলতে হবে।

কালিদাস পাহালিয়া নদী ভাঙনের প্রভাব পড়ছে সোনাগাজী উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নেও। এতে ভিটেমারি হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হওয়ার শঙ্কা প্রবল হয়েছে স্থানীয়দের মনে। ইতোমধ্যে ভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়ে বেশ কয়েক পরিবার নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বেরিয়ে এসেছেন। স্থানীয় আরও ৩ শতাধিক পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়ার দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন।


সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শনিবার (২৮ অক্টোবর) বন্যার পানির নামার পরপর সোনাগাজীর নবাবপুর ইউনিয়নের সুলতানপুর, উত্তর রঘুনাথপুর, মজুপুর মুখের টেক এলাকায় নদী ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করে। ইতোমধ্যে এই তিন এলাকায় ২০টি পরিবারের ঘরসহ ভিটেমাটি নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়াও ইউনিয়নের শাহাবুদ্দিন, অটোরিকশা চালাক হোসেন, জসিমের ঘর-বাড়িসহ ৫০ টি বাড়ির আঙিনা ইতোমধ্যে ভেঙে নদীতে চলে যাওয়ায় বাসিন্দারা আশ্রয় কেন্দ্রসহ অন্যত্র নিরাপদ স্থানে সরে গেছে। আঙিনা আংশিক ভেঙেছে এমন পরিবারের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে।

ভাঙনে বাস্তুচ্যুত হওয়া মজুপুরের শুক্কর আহম্মদ, শাহাদাত এবং মফিজ জানান, নদী ভাঙনে আমরা নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি। বন্যার পানি থাকাকালীনই আমাদের গৃহস্থালি আসবাবপত্র-জিনিসের অধিকাংশ নষ্ট হয়ে যায়। এরপর শুরু হয় নদী ভাঙনে পুরো বসতবাড়ি হারিয়ে ফেলেছি। এখন ভবঘুরের মতো আত্মীয়ের বাড়িসহ এখানে ওখানে পরিবার নিয়ে দিন পার করছি।

নবাবপুর ইউপি চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম জহির জানান, আমার ইউনিয়নের ৫টি ওয়ার্ড নদীর তীরে রয়েছে। নদীর ভাঙনের কবলে পড়ে নদীর কূলের ৩ শতাধিক ঘরবাড়ি ঝুঁকিতে রয়েছে। যাদের বাড়িঘর-আঙিনা নদীতে ভেঙে গেছে তাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এখনো তিনটি পরিবার মজুপুর আশ্রয় কেন্দ্রে থাকছে।

স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোন টেন্ডার না হওয়ায় স্থায়ী কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয় নি। তারা প্রাথমিকভাবে বাঁশ, বল্লি দিয়ে জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙনের তীব্রতা কমানোর চেষ্টা করছেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ড ফেনীর নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদ শাহরিয়া বলেন, লেমুয়া বেইলি ব্রিজের কাজের জন্য বিশ্বব্যাংক থেকে বরাদ্দ আসবে। জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধ করতে হবে।

এ ব্যাপারে ফেনী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাজমুল হাসান জানান, এ ব্যাপারে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে। ছনুয়ার টঙ্গিরপাড়ার কিছু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তাদেরকে টিন ও নগদ অর্থ দেওয়া হয়েছে। লেমুয়ায় ক্ষতিগ্রস্তদের কোনো তালিকা তৈরি করা হয়নি।