লালমনিরহাটে বন্যায় ডুবেছে রেললাইন, পানিবন্দি ২৫ হাজার পরিবার

  • ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, লালমনিরহাট
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

লালমনিরহাটে বন্যায় ডুবেছে রেল লাইন/ছবি: বার্তা২৪.কম

লালমনিরহাটে বন্যায় ডুবেছে রেল লাইন/ছবি: বার্তা২৪.কম

উজানের পাহাড়ি ঢল আর কয়েক দিনের টানা ভারি বৃষ্টিতে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ বেড়ে বিপদ সীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও দুপুরে কমতে শুরু করে। সৃষ্ট বন্যায় তলিয়ে গেছে লালমনিরহাট সান্তাহার রেলরুটের অর্ধকিলোমিটার পথ।

রোববার (২৯ সেপ্টেম্বর) বিকেলে বন্যার পানিতে ডুবে থাকা রেল লাইন সংস্কার করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। বিকেল ৩টা হাতীবান্ধা উপজেলার দোয়ানীতে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ৭ মিটার। যা বিপদ সীমার (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ১৫ মিটার) ৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। এর আগে সকাল ৬টায় বিপদসীমার ২সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।

বিজ্ঞাপন

বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, শনিবার দুপুর থেকে বিপদসীমার কাছাকাছি প্রবাহিত দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে তিস্তা নদীর ডালিয়া পয়েন্টে। রোববার সকাল ৬টায় বিপদসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পরবর্তিতে দুপুর নাগাদ কমে বিপদসীমার নিচে নেমে আসে পানি প্রবাহ। বিকেল ৩টায় বিপদসীমার ৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয় ডালিয়া পয়েন্টে। ফলে বামতীরের জেলা লালমনিরহাটের ৫টি উপজেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ২৫ হাজার পরিবার। প্রতিমুহুর্তে বাড়ছে এর সংখ্যা। আতংকিত হয়ে পড়ে তিস্তাপাড়ের মানুষ।

পানির চাপ বেড়ে যাওয়ায় লালমনিরহাট সান্তাহার রেলরুটের লালমনিরহাট সদর উপজেলার গোকুন্ডা ইউনিয়নের রতিপুর এলাকায় অর্ধকিলোমিটার রেলপথ ডুবে যায়। এ সময় পানির স্রোতে ভেসে যায় রেল লাইনের পাথর। ফলে দিনভর ঝুঁকি নিয়ে ধীর গতিতে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রেখেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। একই সাথে জরুরী ভিত্তিতে সংস্কার করা হয় রেল লাইন। আপাতত রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক রয়েছে।

টানা দুই দিনের বন্যায় নদী তীরবর্তি এলাকার বেশ কিছু রাস্তাঘাট ব্রীজ কালভার্ট ভেঙে গেছে পানির স্রোতে। উঠতি আমন ধান ও বিভিন্ন সবজি ক্ষেত ডুবে আছে বন্যার পানিতে। দীর্ঘ সময় ডুবে থাকলে এসব ফসলের মারাত্বক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন চাষিরা। একই সাথে বন্যার পানির তোড়ে ভেসে গেছে বেশ কিছু পুকুরে মাছ। মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ন হয়ে পড়েছে সলেডি স্প্যার বাঁধসহ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো। শনিবার রাতভর সলেডি স্প্যার বাঁধ-২ এর উপর দিয়ে পানি ওভার ফ্লো প্রবাহিত হয়। বাঁধ ভেসে যাওয়ায় শঙ্কায় আতংকিত হয়ে পড়ে ভাটিতে থাকা শত শত পরিবার। স্থানীয়রা রাতে বালু ভর্তি বস্তা ফেলে বাঁধ রক্ষা করে।


বন্যার পানিতে বিদ্যালয় ডুবে থাকায় জেলার ১৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বপন কুমার। গবাদি পশু পাখি নিয়েও নিদারুণ কষ্টে পড়েছেন খামাড়ি ও সাধারণ কৃষকরা। ঘর বাড়িতে পানি প্রবেশ করায় রাস্তা বা বাঁধের উচু স্থানে পলিথিন সাঁটিয়ে রাখা হয়েছে এসব গৃহপালিত পশু পাখি। অনেক পরিবার বাড়ি থেকে উচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। বড় বিপাকে পড়েছেন শিশু বৃদ্ধ আর প্রতিবন্ধীরা।

পানি বেড়ে যাওয়ায় পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। বন্যা কবলিতদের জন্য জেলা প্রশাসন থেকে ত্রাণ বরাদ্দ দেয়া হলেও তা এখন পর্যন্ত বন্যা কবলিতদের মাঝে বিতরণ শুরু হয়নি। তবে খুব দ্রুতই ত্রাণ বিতরণ শুরু হবে বলে জেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে।

সলেডি স্প্যার বাঁধ-২ এলাকার বাসিন্দা এমদাদুল হক বলেন, রাতে পানির গর্জনে ঘুমাতে পারিনি। সলেডি স্প্যার বাঁধে ব্রীজ অংশের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। এ সময় বাঁধ কাঁপতেছিল। আমরা ভয় পেয়েছিলাম যে, স্প্যার বাঁধ বুঝি ভেসে যায়। স্থানীয়রা রাত জেগে বাঁধে বস্তা ফেলে রক্ষা করেছে। বন্যার সময় নির্ঘুম রাত কাটে তিস্তাপাড়ের মানুষদের।

গোবর্দ্ধন গ্রামের কৃষক মজিদুল ইসলাম বলেন, দুই রাত থেকে তিস্তা নদীতে পানি বাড়ছে। আমাদের গ্রাম পানিতে ডুবে আছে। নৌকা দিয়ে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ির যোগাযোগ করতে হচ্ছে। ডুবে থাকা আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। এ নিয়ে চিন্তায় পড়েছি। আমন ক্ষেত ডুবে গেছে বন্যায়। বেশি সময় এমন থাকলে ধান গাছ পঁচে নষ্ট হতে পারে।


হাতীবান্ধা উপজেলার পশ্চিম বিছনদই গ্রামের তমিজ উদ্দিন বলেন, আমাদের গ্রামে আড়াই/তিন শত পরিবার শুক্রবার থেকে পানিবন্দি। দিন যত যাচ্ছে পানিবন্দির সংখ্যা তত বাড়ছে। রোববার বিকেল নদীতে পানি কমলেও বন্যার পানি খুবই ধীরগতিতে নামছে। ফলে এখনও পানিবন্দি রয়েছি আমরা। বন্যার সময় শিশু বৃদ্ধ আর গবাদি পশুপাখি নিয়ে বড় বিপদে পড়তে হয়। বন্যা হলেই নির্ঘুম রাত কাটাতে হয় তিস্তাপাড়ের মানুষদের। আমরা ত্রাণ নয়, চাই তিস্তার মহাপরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন।

ডাউয়াবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মশিউর রহমান বলেন, আমার ইউনিয়নে তিন/সাড়ে তিন হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বিষয়টি উপজেলা ও জেলা প্রশাসনকে অবগত করা হয়েছে। শুকনো খাবার এখন পর্যন্ত বরাদ্দ আসেনি। বরাদ্দ এলে পৌঁছে দেয়া হবে।

মহিষখোচা ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ হোসত বলেন, আমাদের ইউনিয়নের ৩ হাজারের অধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বাঁধগুলো রক্ষায় সাধারণ মানুষদের নিয়ে বস্তা ফেলে রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে।

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শুনিল কুমার বলেন, রোববার সকাল ৬টায় তিস্তা নদী ডালিয়া পয়েন্টে পানি প্রবাহ বেড়ে বিপদসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর প্রবাহিত হয়। দুপুরে তা কমে গিয়ে বিপদসীমার নিচে নেমে আসে। আশা করছি দ্রুতই বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার বলেন, বন্যা কবলিতদের জন্য ১৩ লাখ টাকা ও ৯০ মেঃটন জিআর চাল বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে। আজকে স্বল্প পরিসরে বিতরন শুরু করেছি। সোমবার সকলের কাছে পৌছে যাবে ত্রাণ। বন্যা বাড়লে তা মোকাবেলা করতে জেলা উপজেলা প্রশাসন আমরা প্রস্তুত রয়েছি।