১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর আল বদর বাহিনীর হাতে নিহত বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে নির্মিত হয় মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ। প্রতিবছর এই দিনটি 'শহীদ বুদ্ধিজীবী' দিবস স্মরণে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুষ্প অর্পণ সহ নানা আয়োজনের মধ্যে দিয়ে পালিত হয়। এবারও যেন এর ব্যতীক্রম নয়। বিশেষ এই দিবস ঘিরে এবারও তোড়জোড়ের কোনো কমতি নেই। নিরাপত্তার চাদরে ঘিরে ফেলা হয়েছে পুরো এলাকা। রং তুলির আঁচড়ে সাজছে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ।
শুক্রবার (১৩ ডিসেম্বর) রাজধানীর মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ ঘুরে প্রস্তুতির এমন চিত্র দেখা গেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের চতুর্দিকে অবস্থিত সীমানা বেষ্টনী সংলগ্ন ভেতরে বাঁশ কাঠ দিয়ে টাঙিয়ে দেওয়া হচ্ছে সাদা কাপড়। অধিকাংশ এলাকায় সাদা ছামিয়ানা দিয়ে সীমানা বেষ্টনীর কাজ শেষ হলেও বাকী অংশের কাজ দ্রুত সময়ে শেষ করতে তোড়জোড় চালিয়ে কাজ করে চলেছেন নির্মাণ শ্রমিকরা।
সীমানা বেষ্টনী সংলগ্ন প্রধান সড়কের পাশে অবস্থিত ফুটপাতে চলছে রং তুলির কাজ। একই সঙ্গে এই স্মৃতিসৌধে প্রবেশ মুখে দুটি প্রধান ফটকের গেটেও চলছে রং তুলির কাজ। এছাড়াও শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ এলাকায় সাদা পোশাকে ওয়াকিটকি হাতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিও দেখা গেছে।
এদিকে নিরাপত্তাজনিত কারণে সাধারণ মানুষকে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের ভেতরে চলাচলও বন্ধ রাখা হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা আবু জাফর বার্তা ২৪.কমকে বলেন, প্রতিবছর এই সময়ে এখানে বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে নানা আয়োজন হয়ে থাকে। সবাই এসে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। এজন্য এদিন এখানে নিরাপত্তার পাশাপাশি সাজানো-গোছানো থাকে।
আরেক দোকানী আমিনুল বার্তা২৪.কমকে বলেন, এই দিনে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল। পরে তাদেরকে এই কবরস্থানে দাফন করা হয়েছিল। তারপর থেকে তাদের স্মরণে এই দিনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালন করা হয়।
কর্মরত রং মিস্ত্রিরা জানান, আগামীকাল রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা এখানে ফুল দিতে আসবেন। তাই তোড়জোড় সহকারে সকাল কাজ শেষ করা হচ্ছে।
মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধটি প্রধানত দুটি অংশে বিভক্ত। দক্ষিণ পাশের অংশটি প্রখ্যাতজনদের জন্য সংরক্ষিত কবরস্থান। উত্তরের বড় অংশটি সাধারণদের জন্য কবরস্থান। এই উত্তর-দক্ষিণের মাঝখানের অংশটিতে অবস্থিত হল এই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ বা স্তম্ভ।
এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেছেন, আগামী ১৪ ডিসেম্বর, ১৬ ডিসেম্বর, ২৫ ডিসেম্বর এবং নববর্ষকে ঘিরে ঢাকাবাসী অনেক স্থানে জমায়েত হবে। এই দিনগুলো ঘিরে নিরাপত্তার কোনো ঘাটতি এবং আশঙ্কা নেই।
উল্লেখ্য, যুদ্ধের শুরু থেকেই পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের জ্ঞানী-গুণী ও মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের হত্যা করে। ১৯৭১ এর ডিসেম্বর মাসে স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে পাকিস্তানী বাহিনী যখন বুঝতে শুরু করে যে তাদের পক্ষে যুদ্ধে জেতা সম্ভব না, তখন তারা নবগঠিত দেশকে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে দুর্বল এবং পঙ্গু করে দেয়ার জন্য পরিকল্পনা করতে থাকে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৪ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনীর সহায়তায় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিজ নিজ গৃহ হতে তুলে এনে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে। এই পরিকল্পিত গণহত্যাটি বাংলাদেশের ইতিহাসে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত। বন্দী অবস্থায় বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের ক্ষত-বিক্ষত ও বিকৃত লাশ রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়। অনেকের মরদেহ শনাক্তও করা যায়নি, পাওয়াও যায়নি বহু লাশ।
১৯৭১ এর ১৪ ডিসেম্বরের নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করে প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশে পালিত হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। বুদ্ধিজীবী হত্যার স্মরণে বাংলাদেশের ঢাকায় বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ স্থাপন করা হয়েছে। ১৯৭২ সালের ২২শে ডিসেম্বর এই সৌধের ফলক উন্মোচন করেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান।