স্কুলছাত্রকে হত্যার পর সন্ধান চেয়ে নিজেই ফেসবুকে পোস্ট দেন তুষার
ফেনীতে স্কুল ছাত্র আহনাফ আল মাঈন নাশিতকে (১০) অপহরণ করে হত্যার ঘটনায় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয় আশ্রাফ হোসেন চৌধুরী তুষার নামে এক ছাত্রদল নেতা। তিনি ঘটনার প্রধান অভিযুক্ত হলেও গ্রেফতারের আগে নিজের ফেইসবুকে নাশিতের সন্ধান চেয়ে তিনটি পোস্ট দেন।
যার মধ্যে দুইটি ছিল- 'আল্লাহ আপনার রহমতের উছিলায় আমাদের ছোট ভাইটাকে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দেন' ও ‘আপনারা কেউ যদি আমার ছোট ভাইটার সন্ধান পেয়ে থাকেন তাহলে অতিদ্রুত যোগাযোগ করুন।’
তার ভাইরাল হওয়া এ পোস্ট নিয়ে চলছে নানা জল্পনা, আলোচনা-সমালোচনা। ফেইসবুকে অনেকে বলছেন আহনাফ নাশিতকে হত্যা করে নিজে পোস্ট দিয়ে ভালো সাজতে চেয়েছিলেন তিনি। এদিকে গ্রেফতার তুষারকে খুনি আখ্যায়িত করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে শাস্তি দাবি করেছেন নাশিতের বাবা মাঈন উদ্দিন সোহাগ।
গ্রেফতার তুষার শহরের একাডেমি এলাকার আতিকুল আলম সড়কের ইকবাল হোসেনের ছেলে। তিনি ফেনী পৌর ছাত্রদলের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তুষার আরাফাত রহমান কোকো স্মৃতি সংসদের সহ-প্রচার সম্পাদক ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জিয়া স্মৃতি সংসদের সাবেক ক্রীড়া সম্পাদক ছিলেন।
এর আগে, বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) দুপুরে শহরতলীর দেওয়ানগঞ্জ রেললাইন সংলগ্ন ডোবা থেকে নাশিতের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তারপর থেকে জেলাজুড়ে বইছে নিন্দার ঝড়। হত্যাকারীদের বিচার দাবিতে উত্তাল ফেনী। ইতোমধ্যে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছে তার এলাকাবাসী ও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত রোববার (৮ ডিসেম্বর) শহরের একাডেমি এলাকার আতিকুল আলম সড়কে লাইট হাউজে কোচিং ক্লাস শেষ করে স্থানীয় বায়তুল খায়ের জামে মসজিদে নামাজ পড়তে যায় আহনাফ নাশিত। নামাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে পূর্বপরিচিত আসামি তুষার ও তার সহযোগীরা নাশিতকে অপহরণ করে দেওয়ানগঞ্জ এলাকায় নিয়ে জুসের সঙ্গে ওষুধ মিশিয়ে অচেতন করেন। পরে নাশিতের ছবি তুলে তার বাবা মাঈন উদ্দিন সোহাগের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে পাঠিয়ে ১২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন তারা। একপর্যায়ে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে মরদেহ রেললাইনের পাশে ডোবায় ফেলে দেন। মরদেহ যেন পানিতে ভেসে না ওঠে সেজন্য ওই শিক্ষার্থীর স্কুল ব্যাগে পাথর ভরে চাপা দেন তারা।
এদিকে ফেনী বিএনপি ও অঙ্গ-সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তুষারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখা গেছে। এ নিয়ে জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। তুষারের ফেসবুক জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খন্দকারের সাথে ছবি ও ঘনিষ্ঠতা দেখা যায়।
এ বিষয়ে জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খন্দকার বলেন, রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে অন্যদের মতো তুষারও আমার কাছে আসতো ছবি তুলতো। সেই সুবাদে আমার সঙ্গে সে ছবি তুলেছে। তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আমার জানা নেই।
জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক মোরশেদ আলম মিলন বলেন, তুষার ছাত্রদলের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকলেও বর্তমানে কোনো পদ-পদবিতে নেই। এমনিতে দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিতেন। ছাত্রদল কোনো অপরাধমূলক কাজের পক্ষে নয়। সে যে হোক আমরা তার শাস্তির দাবি জানাই।
পুলিশ জানায়, এ ঘটনায় নাশিতের বাবা মাঈন উদ্দিন সোহাগ গত ৯ ডিসেম্বর ফেনী মডেল থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরি করেন। তারপর দুই দিন ধরে একটি মোবাইল নম্বর থেকে নাশিতের বাবাকে কল করে ১২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন। পরে বুধবার রাতে নিহতের বাবা মাঈন উদ্দিন সোহাগ পুলিশকে তুষার নামে একজনকে সন্দেহের কথা জানান। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রাতে তুষারকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হলে তার দেওয়া তথ্যমতে দেওয়ানগঞ্জ এলাকার একটি ডোবা থেকে নাশিতের স্কুল ব্যাগসহ মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় গ্রেফতার অন্যরা হলেন- মোবারক হোসেন ওয়াসিম (২০) ও ওমর ফারুক রিফাত (২০)।
এদিকে শুক্রবার (১৩ ডিসেম্বর) নাশিত হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারের দাবিতে শহরের একাডেমী এলাকায় মানববন্ধন করে তার এলাকাবাসী। এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে শহরের ট্রাংক রোড থেকে প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে বিক্ষোভ মিছিল করে ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। বৃহস্পতিবার বাদ মাগরিব ফেনী জি এ একাডেমি স্কুল মাঠে প্রথম জানাজা ও রাত ৯টায় ফুলগাজী সদর ইউনিয়নের জয়পুর আনসার আলী ফকির জামে মসজিদ মাঠে জানাজা শেষে নাশিতের দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
নিহত নাশিত ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার সদর ইউনিয়নের জয়পুর গ্রামের আনসার আলী ফকির বাড়ির মাঈন উদ্দিন সোহাগের ছোট ছেলে। পরিবারের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে ফেনী পৌরসভার একাডেমি এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করতো নাশিত।
নিহত শিক্ষার্থীর বাবা মাঈন উদ্দিন সোহাগ বলেন, আমার ছেলে কোচিং শেষ করে নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে যায়। এরপর বাসায় না ফিরলে আমরা তাকে অনেক খোঁজাখুঁজি করি। রাত ১টার দিকে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে মেসেজ দিয়ে ছেলের ছবি দিয়ে ১২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। মুক্তিপণের টাকা দিতে রাজিও ছিলাম। তারপরও তারা আমার ছেলেকে হত্যা করল।
তিনি বলেন, তুষারকে আমার সন্দেহ হলে পুলিশকে জানাই, পরে পুলিশ তার তথ্যের ভিত্তিতে আমার ছেলের মরদেহ উদ্ধার করে। সে গ্রেফতার হওয়ার আগে ভালো সাজার জন্য ফেসবুকে আমার বিভিন্ন পোস্ট শেয়ার করছিল। নিজে খুন করে নিজেই ভালো সাজতে চেয়েছিল। আমি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।