১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। নানা আয়োজনে ফেনীসহ দেশব্যাপী জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ করে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে সর্বস্তরের মানুষ। প্রকাশিত গেজেটগুলোতে ফেনীর মোট ১০ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হলেও আজও গেজেটে অন্তর্ভুক্ত হয়নি শহীদ কবি ও সাংবাদিক, ফেনীর কৃতি সন্তান সেলিনা পারভীনের নাম।
প্রথম গেজেটে অন্তর্ভুক্ত ১৯১ জন বুদ্ধিজীবীর মধ্যে ফেনীর ৮ জনের নাম রয়েছে। তারা হচ্ছেন- জহির রায়হান, ড. আনম ফজলুল হক মহী, ডা. ক্যাপ্টেন বদিউল আলম চৌধুরী, ইঞ্জিনিয়ার শফিকুল আনোয়ার, ডা. মেজর রেজাউর রহমান, শহীদুল্লাহ কায়সার, ড. সিদ্দিক আহমেদ ও ড. সিরাজুল হক খান।
দ্বিতীয় পর্বে ফেনীর আরও ৩ শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম গেজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তারা হচ্ছেন- ড. রফিক আহমেদ, ইঞ্জিনিয়ার শফিকুল আনোয়ার ও ইঞ্জিনিয়ার সেকান্দর হায়াত চৌধুরী। এর মধ্যে ইঞ্জিনিয়ার শফিকুল আনোয়ারের নাম দুই পর্বে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
তবে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও শেষ হয়নি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়নের কাজ। বিগত সরকার ৩৩৪ শহীদ বুদ্ধিজীবীকে গেজেটের মাধ্যমে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর মধ্যে ফেনীর ১০ জন বুদ্ধিজীবীর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হলেও সেলিনা পারভীনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকা প্রণয়ন সংক্রান্ত যাচাই-বাছাই কমিটির প্রথম সভা হয় ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর। ওই সভায় প্রাথমিকভাবে ১ হাজার ২২২ জনের নাম অনুমোদন করা হয়। পরে অনুমোদন হওয়া ১৯১ জনের নাম প্রথম দফায় গেজেট আকারে প্রকাশ করে সরকার। এর পর গত ২০২২ সালের ২০ জুন দ্বিতীয় দফায় ১৪৩ শহীদ বুদ্ধিজীবীর নামে গেজেট প্রকাশ করা হয়।
একাত্তরের পর থেকে প্রতি বছরই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে মানুষ। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৪ ডিসেম্বরকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ঘোষণা করেছিলেন। কারণ মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ধরে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করলেও আত্মসমর্পণের আগে বিশেষ করে এদিন রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগী বাহিনী পরিকল্পিতভাবে একযোগে বুদ্ধিজীবীদের বাসস্থানে হানা দিয়ে তাদের তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-ডাকসুর সাবেক ভিপি ও অধ্যক্ষ মাহফুজা খানম ‘শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সাংবাদিকতা পদক ২০২০’ প্রদান অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে পাওয়া একমাত্র নারী ছিলেন সেলিনা পারভীন। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে কোনোভাবে স্বীকৃতির কথা নেই, তার নাম উচ্চারিত হয় কিনা আমার জানা নেই। রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল, তাকে আগামী প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করা। কিন্তু সরকারিভাবে সেটা করা হয়নি।
১৯৩১ সালের ৩১ মার্চ ফেনীতে জন্মগ্রহণ করেন সেলিনা পারভীন। তার বাবা আবিদুর রহমান শিক্ষকতা করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের ফেনীর বাড়ি দখল হয়ে যায়। এরপর তারা চলে যান ঢাকায়।
১৯৬৯’র গণঅভ্যুত্থান আন্দোলনে উত্তাল বাংলাদেশ। জাতির ক্রান্তিকালে সেলিনা নিজেও শরিক হয়েছিলেন এ আন্দোলনে। ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন '৬৯-এর আন্দোলনে, ২১ ফেব্রুয়ারির সভা কিংবা পল্টনের জনসভায়। যোগ দিতেন শহীদ মিনার থেকে বের হওয়া নারীদের মিছিলে। শরিক হতেন বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদ সভায়ও।
অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সারের মত ব্যক্তিদের সাথে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে সমাজতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল হয়ে পড়েন তিনি। এরই মধ্যে শুরু হলো মহান মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেলিনা পারভীন কোথাও পালিয়ে যাননি। ঢাকায় নিজ বাসায় অবস্থান করেছিলেন পরিবার নিয়ে। যুদ্ধকালীন সময়ে তরুণরা তার বাসায় গিয়ে খাওয়া দাওয়া করতেন এবং প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র সংগ্রহ করে চলে যেতেন।
১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল। দেশ স্বাধীন হতে আর মাত্র তিনদিন বাকি। দেশের বেশ কিছু অঞ্চল ইতিমধ্যে মুক্ত হয়ে গেছে। সাংবাদিক সেলিনা পারভীন তখন বাস করতেন সিদ্ধেশ্বরীতে। ১১৫ নিউ সার্কুলার রোডে। বাড়িতে তারা তিন জন থাকতেন। শিশু পুত্র সুমনসহ তিনি, মা আর তার ভাই উজিরউদ্দিন।
সেদিন শীতের সকালে তারা সবাই ছিলেন ছাদে। সেলিনা পারভীন সুমনের গায়ে তেল মাখিয়ে দিচ্ছিলেন। সুমন যখন ছাদে খেলাধুলা করছিলো। সেলিনা চেয়ারে বসে বসে একটি লেখা তৈরি করছিলেন। সারা শহরজুড়ে তখন কারফিউ চলছিলো। রাস্তায় পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য বিমান থেকে চিঠি ফেলা হচ্ছে। হঠাৎ দূরে একটা গাড়ির আওয়াজ হলো। সুমনদের বাড়ির উল্টো দিকে ই.পি.আর.টিসি-এর ফিয়াট মাইক্রোবাস ও লরি থামলো। সেই বাসার প্রধান গেইট ভেঙে ভেতরে ঢুকে গেল কয়েকজন লোক। তাদের সবাই একই রঙের পোশাক পরা। মুখ রুমাল দিয়ে ঢাকা।
সুমনদের ফ্ল্যাটে এসে একসময় কড়া নাড়ে তারা। সেলিনা পারভীন নিজে দরজা খুলে দেন। লোকগুলো তার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। এ সময় সেলিনা পারভীনের সাথে লোকগুলোর বেশ কিছু কথা হয়। এরপর তারা সেলিনা পারভীনকে তাদের সাথে নিয়ে যায়। সেই যে তিনি গেলেন, আর ফিরে এলেন না।
১৮ ডিসেম্বর সেলিনার গুলি-বেয়নেটে ক্ষত বিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া গেলো রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। ডিসেম্বরের শীতের কারণে সেলিনা পায়ে মোজা পড়া ছিলেন। মৃতদেহ যখন পাওয়া যায় তখনও তার পায়ে ছিলো সাদা মোজা। এটি দেখেই তাকে শনাক্ত করা হয়। ১৪ ডিসেম্বর আরও অনেক বুদ্ধিজীবীর মতো সেলিনা পারভীনকে হত্যা করা হয়। পরে ১৮ ডিসেম্বর আজিমপুর কবরস্থানে শহীদদের জন্য সংরক্ষিত স্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।
দেশকে ভালোবেসে প্রাণ দিয়েছেন সাংবাদিক সেলিনা পারভীন। শহিদ বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভীন ছিলেন স্বাধীনচেতা এক নারী। একজন নির্ভীক কলম সৈনিক। যিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সাংবাদিকতা করে গেছেন। অবিলম্বে দ্রুত শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনকে গেজেটে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন ফেনীর বীর মুক্তিযোদ্ধা, সুশীল সমাজ ও সাধারণ মানুষ।