দেশের সর্বপ্রথম ভিক্ষুক মুক্ত নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলায় আবারো পুরনো পেশায় ফিরেছে ভিক্ষুকেরা। ২০১৪ সালে এ উপজেলাকে ভিক্ষুকমুক্ত করার উদ্যোগ নেয় উপজেলা প্রশাসন ও সমাজসেবা অধিদফতর। কিন্তু সেই উদ্যোগের সুফল মেলেনি এখনো। ভিক্ষুকেরা বলছেন, সরকারি সুবিধায় পেট না চলায় এখনো তারা বিভিন্ন এলাকায় করছেন ভিক্ষাবৃত্তি।
বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, আগের মত নিয়মিত বিভিন্ন গ্রাম, হাট-বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,হাসপাতালসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে ভিক্ষাবৃত্তি করছেন তারা। উপজেলা প্রশাসন থেকে যাদের পুনর্বাসন করা হয়েছিলো তারা অনেকেই আবার এ পেশায় ফিরেছে। অনেক জায়গায় পেটের দায়ে আবার বেড়েছে নতুন ভিক্ষুক। উপজেলা প্রশাসনের বিভিন্ন সুবিধা ভাতার আওতায় থাকা ভিক্ষুকেরা সীমিত ভাতায় পেট না চলায় তারাও করছেন ভিক্ষা। স্থানীয়রা বলছেন, ভিক্ষুক পুনর্বাসনের বরাদ্দ ও প্রকল্প শুধু খাতায় কলমে সীমাবদ্ধ বাস্তবে ১০ বছরে সুফল মেলেনি।
আরও দেখা যায়, বাংলাদেশ জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদের অর্থায়নে উপজেলা প্রশাসন ও সমাজসেবা কার্যলয়ের সহায়তায় কয়েকজন ভিক্ষুককে মুদি দোকান দিয়ে দেওয়া হয়। মুদি দোকান দেওয়ার পরে কিছুদিন ভালো চললেও পরে মালামাল ও আর্থিক সংকটের কারণে বেচাবিক্রি বন্ধ হয়ে যায়। পরে পেট চালাতে বাধ্য হয়ে আবার ভিক্ষাবৃত্তিতে নেমেছে মুদি দোকান পাওয়া কয়েকজন ভিক্ষুক।
উপজেলা সমাজসেবা অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলার ১৩০৬ জন ভিক্ষুককে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় পুনর্বাসন করা হয়। এরমধ্যে ৫৪ জনকে দোকান ঘর, ছাগল ও নগদ অর্থ দিয়ে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এছাড়াও বাকিদের বিভিন্ন সরকারি ভাতার আওতায় আনা হয়েছে।
বাজারে ভিক্ষা করতে আসা মাগুড়া শাহ পাড়া এলাকার ভিক্ষুক নালটু মিয়া বলেন, আমাকে গত চার বছর আগে উপজেলা প্রশাসন থেকে একটি ছাগল ও নগদ কিছু টাকা দেওয়া হয়েছিলো। আমাকে বলেছিলো আমাকে একটা দোকান করে দিবে কিন্তু পরে আমি দোকনটি পাইনি। একটি মাত্র ছাগল দিয়ে আমি ও আমার বউ খেতে পারি না। পরে টাকা শেষ হয়ে গেলে আশপাশের লোকজনের কাছ থেকে সহায়তা নিয়ে কয়েকদিন চলেছি। পরে আমি পেট চালাতে বাধ্য হয়ে আবার ভিক্ষা করতে শুরু করেছি।
পুটিমারি ছাদুরারপুল বাজার এলাকার ভিক্ষুক শাহাবুল ইসলাম বলেন, তিনি দীর্ঘদিন ধরে ভিক্ষা করে এক প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে সংসার চালাচ্ছিলেন ৷ পরে তিনি উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় পুনর্বাসন প্রকল্পের আওতায় একটি মুদি দোকান পায়। দোকান পাওয়ার পর কিছু দিন ভালোভাবে চললেও পরে মালামাল সংকট কারণে টিকতে পারেনি। আবারও মানবেতর জীবনযাপনে ফিরে যায় তিনি৷ পরে তিনি বাধ্য হয়ে মেয়ে আর বউয়ের মুখে ভাত জুটাতে ফিরেন ভিক্ষাবৃত্তিতে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের উপজেলা প্রশাসন থেকে যেসব সহায়তা দিয়েছিলো সেগুলো দিয়ে দীর্ঘসময় সংসার চলে না৷ আমাদের যে মুদি দোকান দিয়েছিলো সেখানে ভালো মতো বেচা বিক্রি হয় না, মালামাল কম। সেখান থেকে অনেকে বাকি নিয়ে যায়। তারা গ্রামের ভিতরে যে দোকান দিয়ে দিসে তা দিয়ে পেট চলে না। আমাদের পেট আর সংসার চালাতে ভালো কোনো উপায় করে দিলে আমরা আয় রোজকার করে খেতে পারতাম৷
ভিক্ষুক আছিয়া বেগম বলেন, ভাত খেতে পারিনা অভাবের তাড়নায় ভিক্ষা করি। আমার ছেলে ঢাকায় গেছে চলে আমার খোঁজখবর নেয়না। আমার একবার একটা ছাগল আর কিছু টাকা দিয়েছিলো সেটা দিয়ে আর কত দিন চলতে পারব। পরে কোনো উপায় না পেয়ে ভিক্ষা করছি।
থানা মোড় এলাকার ব্যবসায়ী মতিন মিয়া বলেন, ভিক্ষুক মুক্ত ঘোষণার কিছুদিন পর ভিক্ষুক ছিলো না। তারপর প্রায় ১ বছর পরে আবার ভিক্ষুক বেড়েছে। দোকানে বসে থাকি দিনে প্রায় ১০-১৫ জন ভিক্ষুক আসে ভিক্ষা নিতে। দেখা যায়, অনেকের খাবার জুটে না তারা এজন্য ভিক্ষা করছেন ৷ যারা ভিক্ষা করতে আসে তাদের অনেকে বয়স্ক ঠিকমত হাটতে পারেনা। ভিক্ষুকরা আসলে যত টাকা পারি সাহায্য করি।
শহরের ভ্যান চালক লাল মিয়া বলেন, আমরা ভ্যান গাড়ি নিয়ে চলাচল করি। ভিক্ষুকতো চোখে দেখি প্রতিদিন তারা ভিক্ষা করেন। শুনেছি তাদের নাকি ছাগল দিলো গরু দিলো তবুও তারা আবার ভিক্ষা করছেন।
এ বিষয়ে উপজেলা সেচ্ছাসেবী সংগঠন সেবা ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক রফিক শাহ বলেন, কিশোরগঞ্জ উপজেলা দেশের সর্বপ্রথম ভিক্ষুক মুক্ত হয়েছিলো। আমাদের উপজেলা প্রশাসন থেকে দীর্ঘমেয়াদি কোনো সহায়তার ব্যবস্থা করলে ভিক্ষুকরা ভালোভাবে সংসার চালাতে পারবেন, তারা আর ভিক্ষাবৃত্তিতে নামবে না। আমরাও উপজেলার অসহায় মানুষ ও ভিক্ষুকদের বিভিন্ন ভাবে সহায়তা করে থাকি।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা জাকির হোসেন বলেন, ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনে বিভিন্ন প্রকল্প দেওয়া হয়েছে। তাদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করা হচ্ছে, অনেকে অভ্যাসের কারনে এ পেশা ছাড়ছে না। আমরা তাদের পূর্ণবাসনে বিভিন্ন ভাবে সহায়তা করছি।
এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)মৌসুমি হকের সাথে যোগাযোগ করে মন্তব্য পাওয়া যায়নি।