বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আব্দুল কাদের ও হামজা মাহবুবের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন কেলেঙ্কারির দায়ে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া ফেনী আলিয়া কামিল মাদরাসা অধ্যক্ষ মাওলানা মাহমুদুল হাসানকে স্বপদে বহাল রাখার আশ্বাস দিয়ে ৩ লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ উঠেছে ওমর ফারুক শুভ নামে ফেনীর এক সমন্বয়কের বিরুদ্ধে।
এতে তিনি মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থী ফেনীর সন্তান আজিজুর রহমান রিজভীর নামও উল্লেখ করেন।ইতোমধ্যে সমন্বয়ক শুভকে চাঁদাবাজি, প্রতারণা ও মানহানির অভিযোগে করা এক মামলায় গ্রেফতার করেছে ফেনী মডেল থানা পুলিশ।
মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) চাঁদা দাবির ১৫ মিনিট ১২ সেকেন্ডের একটি কল রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে জেলাজুড়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা সৃষ্টি হয়। এরমধ্যে শুভর বিরুদ্ধে প্রতারণা, চাঁদাবাজি ও মানহানির অভিযোগ এনে রিজভীর পক্ষে মামলা দায়ের করেন তার বাবা ছিদ্দিকুর রহমান। পরবর্তীতে রাত সাড়ে ১১ টায় শহরের মডেল থানা সংলগ্ন এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ফেনী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মর্ম সিংহ ত্রিপুরা।
গ্রেফতার ওমর ফারুক শুভ ফেনী সদর উপজেলার ফরহাদনগর ইউনিয়নের জগতজীবনপুর গ্রামের নুরুজ্জামানের ছেলে। গত আগস্টে আন্দোলনে শৃঙ্খলাবিরোধী কার্যক্রমে জড়িত থাকায় তাকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ফেনী জেলার সহ-সমন্বয়ক পদ থেকে বহিষ্কার করা হলেও বিগত কয়েক মাস ধরে জেলার অন্য সমন্বয়ক ও ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে ‘সমন্বয়ক’ পরিচয় দিয়েই শুভ বিভিন্ন কর্মসূচি ও সভা-সমাবেশে অংশ নেয়।
ভাইরাল ওই কল রেকর্ডে শোনা যায়, সমন্বয়ক ওমর ফারুক শুভ অধ্যক্ষ মাহমুদুল হাসানকে বলছেন প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনুসের সাথে হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয়। এছাড়াও তিনি উপদেষ্টাদের সাথে তার নিয়মিত যোগাযোগ হওয়াসহ নিজে সেন্ট্রালে (কেন্দ্রীয়) লিড দেন বলে দাবি করেন। এসময় তিনি সেন্ট্রাল সমন্বয়করা জামায়াত সমর্থিত উল্লেখ করে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বিএনপি করে বলে জানান এবং নাহিদের বাবা বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের সঙ্গে ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে যুবদল করে বলে উল্লেখ করেন। পাশাপাশি নাহিদের পিএসের তার সারাক্ষণ যোগাযোগ রয়েছে বলে জানান।
কল রেকর্ডে শোনা যায়,ওমর ফারুক শুভ কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের কথা বলে অধ্যক্ষ মাওলানা মাহমুদুল হাসানের কাছে ৩ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন।
অধ্যক্ষের সঙ্গে কথোপকথনে শুভ বলেন, 'আপনি (অধ্যক্ষ) আমার ওস্তাদ মানুষ, আমি আপনাকে কি বলবো। কোন মেয়ের গায়ে নাকি আপনি হাত দিয়েছেন। এটি সেন্ট্রালে অভিযোগ করা হয়েছে। সেন্ট্রাল থেকে আমাকে বলা হয়েছে। আজকেও রিজভী ভাই ফোন দিয়েছে। বলেছে, শুভ মিটিংয়ের পর তোমাকে আব্দুল কাদের আর হামজা ভাই কি বলছে তুমি তো দেখেছো? তুমি আব্দুল কাদের আর হামজা ভাইকে বলো আমরা একটা এমাউন্ট দিয়ে দিব, এগুলাে নিয়ে ওরা (কাদের-হামজা) বিভিন্ন জায়গায় মতবিনিময় সভা করবে, ওখানে ভাড়ার জন্য ব্যবহার করবে।
শুভ বলেন, আজকেও আমাকে ফোন দিয়েছে, এজন্য আপনাকে ফোন দিয়েছি। এখন আপনি বলেন, আমি কি আপনাকে গত এক মাস কল দিয়েছি? দি নাই। আমার আগ্রহ ছিল না। এখন কেন দিয়েছি, তারা বলছে এজন্য দিয়েছি। আমি তো আর আমার পকেট থেকে দেওয়া সম্ভব না। আমি ১ হাজার, ২, ৪ ও ৫ হাজার টাকা দিতে পারবো। কিন্তু এক-দুই, পাঁচ লাখ টাকা তো আর দেওয়া সম্ভব না।
অধ্যক্ষকে শুভ আরও বলেন, 'আপনি যাদের প্রিয় মনে করেন তারা আসলে আপনার প্রিয় না। আপনাকে আরও আপডেট জানাব। বেশিদিন না, সামনের মাসের ১৫ তারিখের আগেই সেরে ফেলব। আমি সব দিয়ে চেষ্টা করতেছি। সরাসরি কাউন্টার দিচ্ছি। আমি আলিয়াতে নিয়মিত ক্লাস করব। আপনিও আসবেন। আমি ট্রু করলে সবাই বিড়ালের মতো চলে যাবে। মারা লাগবে না, চোখ রাঙালেই হবে। আমার সঙ্গে শুধু কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক না, ড. ইউনুসের সঙ্গেও হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয়। আমি একজন সমন্বয়ক। সেন্ট্রালে লিড দিয়ে থাকি। উপদেষ্টাদের সঙ্গেও যোগাযোগ হয়। আর আপনাকে যেটা বলছি, ওটা করলে করবেন, না করলে জানিয়ে দিবেন। কারণ আমি তাদের না করে দিতে হবে।'
কথোপকথনে অধ্যক্ষ পদ ফিরে পেতে কত টাকা লাগবে এমন প্রশ্ন করলে শুভ বলেন, 'হুজুর সে (রিজভী) আমারে বলেছে পাঁচ। আমি বলেছি, আস্তাগফিরুল্লাহ, হুজুরের মাসিক বেতনই ৩৫-৪০ হাজার টাকা। হুজুর এক বছরের বেতন দিলেও ৫ লাখ টাকা হবে না। তাছাড়া হুজুর গত দুই মাস অফিসও করতে পারছে না। বেতনও বন্ধ। আমারে কল দিয়ে বলেছে, ৫ লাখ নাও, হামজা-কাদেরকে পাঠাবো।
অধ্যক্ষ মাহমুদুল হাসান কত লাগবে আবারও প্রশ্ন করলে শুভ বলেন, '৩ লাখ টাকা লাগবে বলেছে। সে (রিজভী) বলছে, এটা কাদের ভাই ও হামজা ভাইকে দিয়ে দিবে। তাহলে আপনার আর সমস্যা হবে না। হুজুর বুঝিয়েন, এরা সেন্ট্রাল সমন্বয়ক। আমি তো তাদের সাথে টকিং এ যেতে পারি না। আমি কিছু বললে আমারেও বহিষ্কার করে দিবে, তখন আমি কিছু করতে পারব? কারণ এখন তাদের ক্ষমতা। আর আমারে যদি বহিষ্কার করে তাহলে আপনার প্রতি স্ট্রিমরোলার চলবে। আর সেন্ট্রালে যারা আছে তারা জামায়াত সমর্থিত। আর আমাদের নাহিদ ভাই (তথ্য উপদেষ্টা) বিএনপি করে। নাহিদের বাবা মির্জা আব্বাসের সঙ্গে ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে যুবদল করে। নাহিদের যে পিএস আছে সে সারাক্ষণ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। আমি আপনার জন্য নাহিদের সঙ্গে সর্বোচ্চ লবিং করতেছি। ওস্তাদ হিসেবে বলতেছি, আমার কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হামজা মাহবুব বলেন,ফেনীতে আন্দোলনের পরবর্তী আমাদের কোনো কমিটি নেই। ইতোমধ্যে শুভর বিষয়টি অবগত হয়েছি। তারা আন্দোলনের সমন্বয়ক হিসেবেই এখনো কাজ করছেন। কমিটি না থাকায় এ মুহূর্তে অভিযুক্ত শুভর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে আলোচনা চলছে।
ভাইরাল হওয়া কলরেকর্ড সুপার এডিট করা উল্লেখ করে গ্রেফতারের আগে অভিযোগের বিষয়ে ওমর ফারুক শুভ বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বক্তব্য সুপার এডিট করা। এটি আমার কণ্ঠ না। আমার কাজের মাধ্যমে আমি ফেনীতে জনপ্রিয় হয়ে গেছি। সেজন্য আমাকে হেয়প্রতিপন্ন করতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কিছু লোক ষড়যন্ত্র করছে। চাঁদাবাজির এই ধরনের ঘটনার সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা নেই।
এদিকে প্রতারণা, চাঁদাবাজি ও মানহানির অভিযোগে সমন্বয়ক শুভকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার রাতে আজিজুর রহমান রিজভীর পক্ষে তার বাবা ছিদ্দিকুর রহমান বাদী হয়ে ওমর ফারুক শুভকে আসামি করে ফেনী মডেল থানায় একটি মামলা করেন। পরে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
এ বিষয়ে আজিজুর রহমান রিজভী বলেন, শুভর সাথে প্রথম ও শেষ দেখা ফেনীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের মতবিনিময় সভায়। পরবর্তীতে শুভ বিভিন্ন সময় আমাকে ফোনকলে, ম্যাসেজ দিয়ে ফেনীর কমিটিতে তার নাম উপরে দেওয়ার জন্য বলতেন। অন্যকোন কথা তার সাথে হয়নি।
তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক, তথ্য উপদেষ্টা ও আমার নাম ভাঙিয়ে সে চাঁদাবাজি করার চেষ্টা করেছে। তার সাথে নূন্যতম যোগাযোগ ও সংশ্লিষ্টতা না থাকা সত্ত্বেও তার এমন কাণ্ড আমার জন্য সম্মানহানিকর। বিষয়টি অবগত হয়ে আমি ফেনী মডেল থানায় অভিযোগ করেছি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানার একটি আশীর্বাদ স্বরূপ। এসব নামে-বেনামে সমন্বয়কদের কারণে এ ব্যানারের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়, এমন কোনো কাজে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই।
ফেনী মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মর্ম সিংহ ত্রিপুরা বলেন, মামলা করার পর অভিযান চালিয়ে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে। বুধবার আদালতের মাধ্যমে শুভকে কারাগারে পাঠানো হবে।