নতুন বই পাচ্ছে না অনেক শিক্ষার্থী, কমেছে উপস্থিতি

  • স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা ২৪

ছবি: বার্তা ২৪

পুরাতন গ্লানি মুছে শুরু হয়েছে নতুন বছরের যাত্রা। নতুন এই শিক্ষাবর্ষে নতুন শিক্ষাক্রম বাদ দিয়ে পুরোনো শিক্ষাক্রমে ফিরছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা। বিগত বছরগুলোতে নতুন শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিনেই শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন পাঠ্যবই পৌঁছে দেয়া হলেও এই রীতিতে ভাটা পরেছে চলতি বছর। বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছায়নি নতুন বই। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমেছে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি। নেই নতুন বইয়ের গন্ধে আনন্দ উল্লাসিত হয়ে বিদ্যালয়ে প্রফুল্লতার চিত্রও।

তবে এই সংকট দ্রুত সমাধান শেষে শিগ্রই শিক্ষার্থীরা পূর্বের ন্যায় ক্লাসরুমে ফিরবেন বলে আশাবাদী শিক্ষকরা।

বিজ্ঞাপন

বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ রাজধানীর মোহাম্মদপুর খিলজী রোডে অবস্থিত সরকারি জামিলা আইনুল আনন্দ বিদ্যালয় ও কলেজ ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বছরের শুরুতে নতুন বই উৎসবের পর শিক্ষার্থীদের নতুন বই হাতে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আগমন, হৈ-হুল্লোড়, খেলাধুলা এবং পাঠগ্রহণের যে চিত্র পূর্বের বছরগুলোতে দেখা গেছে এবার এসবের বিন্দু মাত্র লেশ নেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিও নেই চোখে পরার মতন। শিক্ষকরা ব্যস্ত সময় পার করছেন দাপ্তরিক কাজে। ঘড়ির কাটায় ঘণ্টা পেরুলে বাজছে না বিদ্যালয়ের ঘণ্টা।

বিজ্ঞাপন

সরকারি জামিলা আইনুল আনন্দ বিদ্যালয় ও কলেজের প্রধান শিক্ষক মো. মোজাম্মেল হক পাটওয়ারী বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমি বহু বছরের মধ্যে শিক্ষার্থীদের এতো কম উপস্থিতি দেখি নাই। শিক্ষার্থীরা এবং অভিভাবকরা যেটা ভাবছে যে যেহেতু অধিকাংশ শিক্ষার্থী নতুন বই হাতে পাইনি সেহেতু ক্লাস কার্যক্রম কিভাবে চলবে এটা ভেবেই শিক্ষার্থীদের এতো কম উপস্থিতি। আমরা শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের মেসেজ পাঠিয়েছি। ফোন দিয়ে ক্লাসে ফেরার আহ্বান জানাচ্ছি। আশা করি কয়েকদিনের মধ্যে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরবে।


তিনি বলেন, তাছাড়া বাস্তবতাও মেনে নিতে হবে। এইযে বিগত বছরগুলোতে বছরের প্রথম দিনে যে বইগুলো চলে আসতো আমরা শিক্ষকরা সেটাকে খারাপ দৃষ্টিতে নিচ্ছি না। নিসন্দেহে সেটা অনেক ভালো। আমরা নিজেরা যখন শিক্ষার্থী ছিলাম তখন আমাদের বই পেতে পেতেই এক দুই মাস চলে যেত। আজ একটা পেতাম, কাল আর একটা পেতাম এভাবে বই পেতাম। এই তুলনায় বিগত বছরগুলোতে যখন একত্রে শিক্ষার্থীরা প্রথমেই সব বইগুলো পেয়ে যেতো শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেক আনন্দ নিয়ে ক্লাসরুমে ফেরা লক্ষ্য করা যেতো। আমি এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আজ ২৯ বছর চাকরি করছি। আমরা বছরের প্রথম দিন থেকেই ক্লাসের সকল কার্যক্রম চালু করতাম এটা আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটা ঐতিহ্য। সেই হিসেবে আমরা এবার মর্মাহত।

তাছাড়া আরও একটা বিষয় বাস্তবতা মেনে নিতে হবে যে এমন কিছু বিষয় বইয়ে ছিল সত্যিকার অর্থে সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। যেমন ধরেন একটা গ্রেট মুক্তিযুদ্ধ কি কোন এক ব্যক্তির হাত ধরে হয়। আমাদের বইয়ের পরতে পরতে সেটাই ছিল। এগুলা সত্যিকার অর্থেই সংশোধনের একটা বিষয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে কে কিভাবে বলবে তা আমি জানিনা তবে আমি আমার অন্তর থেকে তাকে মানি। কিন্তু অসম্ভব যে একজনের হাত ধরেই একটা মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধে তো একটা সর্বদলীয় কমিটি ছিল আমার বইয়ের কোথাও কি সেটা আছে? নেই। তাই এসব বিষয় বই থেকে চেঞ্জ করে কিছুটা বাস্তবতা নিয়ে আসা জরুরি। তারপরে ৫ তারিখে একটা বড় রকমের পরিবর্তন ঘটেছে, সেসব বিষয় আনার জন্য বইয়ের একটু সংশোধনের ব্যাপারও আছে। এ কারণেই আমরা বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে একটু অপেক্ষা করছি। তার পরেও বই আসছে। বেশ কিছু বই এসেছে ও। আশা করছি কয়েকদিনের মধ্যে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

সহকারী শিক্ষক শোয়েব আহমেদ বার্তা২৪.কমকে বলেন, ক্লাসে তেমন কোন উপস্থিতি নেই। আশেপাশে বেশ কয়েকটি স্কুলেও দেখলাম তাদেরও একই অবস্থা উপস্থিতি নেই। উচ্চভমাধ্যমিকে কিছু কিছু উপস্থিতি আছে, কিন্তু মাধ্যমিক ও প্রাথমিকে উপস্থিতি নাই। বই নেই তাদের হাতে তারা আসলে কি করবে। উচ্চ মাধ্যমিকে কয়েকজন করে উপস্থিতি আছে কিন্তু স্কুল একদম খালি।

এদিকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ৪৪১টি বই পরিমার্জন করা হয়েছে, যা অনলাইনে এনসিটিবির ওয়েবসাইটে বইয়ের পিডিএফ কপি পাওয়া যাবে আজ থেকে।

নতুন বই সবার হাতে দিতে না পারায় পাঠ্যবইয়ের অনলাইন ভার্সনে প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ কার্যক্রম বুধবার (১ জানুয়ারি) সকালে রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে উদ্বোধন করেন অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।


তবে পাঠ্যবইয়ের বিকল্প হিসেবে পাঠ্যবইয়ের অনলাইন ভার্সনে পড়াশোনায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে কতটা প্রভাব পড়বে বা স্বাচ্ছন্দ পাবে জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক মো. মোজাম্মেল হক পাটওয়ারী বার্তা২৪.কমকে বলেন, পাঠ্য বইয়ের মতন অনলাইনে হবে না। তবে যদি নতুন সংস্করণের পাঠ্য বই হাতে পেতে দেরি হয় তাহলে শিক্ষকরা অনলাইন থেকে পাঠদান এর কার্যক্রম কিছুটা সামনে এগিয়ে নিতে পারবে। ফলে শিক্ষার্থীরাও এটা থেকে এগোতে পারবে। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা উভয়ে অনলাইন থেকে কিছুটা সাহায্য নিতে পারবে। তবে শিক্ষার্থীরা কতটা নিবে সেটা আমরা বলতে পারি না। পাঠ্য বইয়ের অনলাইন ভার্সন এটা কোন স্থায়ী সমাধান না। এটা হল হাতে বই আসার আগ পর্যন্ত কোনোভাবে পাঠদান কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া।

এনসিটিবি সূত্রমতে, নতুন শিক্ষাবর্ষে চার কোটির মতো শিক্ষার্থীর জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য ৪০ কোটির বেশি বই ছাপানো হচ্ছে।

প্রাক্-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবইয়ের সংখ্যা ৯ কোটি ৬৪ লাখের মতো। এর মধ্যে সোমবার পর্যন্ত উপজেলা পর্যায়ে পাঠানোর জন্য ছাড়পত্র হয়েছে ৩ কোটি ৯৪ লাখ বইয়ের; আর মাধ্যমিকে (মাদ্রাসার ইবতেদায়িসহ) বইয়ের সংখ্যা ৩০ কোটি ৯৬ লাখের মতো। এর মধ্যে গতকাল বিকেল পর্যন্ত ছাড়পত্র হয়েছে ২ কোটি ৮ লাখ ২৪ হাজারের মতো। অর্থাৎ বিপুলসংখ্যক বই এখনো উপজেলায় পাঠানো যায়নি।

এদিকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ৪৪১টি বই পরিমার্জন করা হয়েছে, যা অনলাইনে এনসিটিবির ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে আজ থেকেই।

গতকাল বুধবার (১ জানুয়ারি) সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান একেএম রিয়াজুল হাসান এসব কথা বলেন।

এনসিটিবি চেয়ারম্যান বলেন, ৫ জানুয়ারির মধ্যে প্রাথমিকের বাকি সব বই ও মাধ্যমিকের ৮টি বই পৌঁছে যাবে শিক্ষার্থীদের হাতে। এ ছাড়াও ১০ জানুয়ারির মধ্যে মাধ্যমিকের দশম শ্রেণির বই ও ২০ তারিখের মধ্যে সব শ্রেণির বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে যাবে। ৪১ কোটির মধ্যে ৬ কোটি বই দেওয়া হয়ে গেছে, আরও ৪ কোটি বই দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

২০২৫ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারের বিনামূল্যের মূল পাঠ্যবইগুলোর মধ্যে ৬৯১টি বই নতুন করে পরিমার্জন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৪১টি বইয়ের পরিমার্জন সম্পন্ন করে পিডিএফ ভার্সনে রূপান্তর করা সম্পন্ন হয়েছে, যা ইতোমধ্যে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়েছে।