ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ, নিন্দা ও প্রতিবাদ করেছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্পূর্ণ জ্ঞাতসারে নির্মমতার সঙ্গে বাড়িটি ধ্বংস করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে ঘটনা পরবর্তী একটি বিবৃতি দিয়ে এ দায় এড়ানোর সুযোগ নেই বলে জানান বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী ২৬ নাগরিক।
শুক্রবার (৭ ফেব্রুয়ারি) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এই তথ্য জানান তারা।
বিবৃতিতে উল্লেখ করেন, ৫ ফেব্রুয়ারি (বুধবার) যেভাবে ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতে অবস্থিত শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক বাড়িটি ক্রেন, বুলডোজার ব্যবহার করে নির্মমভাবে ধূলিসাৎ করা হয়েছে এবং তার সঙ্গে অন্য যেসব স্থাপনা পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সম্পূর্ণ জ্ঞাতসারে নির্মমতার সাথে ধ্বংস করা হয়েছে, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তা দেখে একটি সভ্য দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা গভীরভাবে মর্মাহত, স্তম্ভিত ও লজ্জিত। এ ঘটনার আমরা বিচার চাই।’
বিবৃতিদাতারা আরও বলেন, ‘এমন লজ্জাজনক ঘটনার নিন্দা ও ধিক্কার জানানোর উপযুক্ত ভাষা আমাদের জানা নেই। ঘটনাটির আমরা তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। এর সম্পূর্ণ সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবি আমরা জানাতে চাই; কিন্তু কার কাছে জানাব? আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলো হয় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে, কিংবা সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ছিল; কিন্তু কেন? তাদের জনগণের ট্যাক্স ও অর্থে লালনপালন করা হয় কি নীরব দর্শক হয়ে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করার জন্য? যখন তাদেরই নাকের ডগায় প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়, তখন তারা নীরব–নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকা পালনের অর্থ কী? অপরাধের সহযোগী হওয়ার সমার্থক নয়?’
‘কোনো ধরনের গণ–উত্তেজক সহিংসতা বা মব ভায়োলেন্স কেবলমাত্র ফ্যাসিবাদের কর্মী-সমর্থক এবং তাদের আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকদের নাশকতা সৃষ্টির প্রচেষ্টাকেই উৎসাহিত করবে। বিগত পতিত সরকার ও তার সহযোগীরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে নানা নাশকতার পরিকল্পনা যেমন করেছে, তেমনি দেশে এখন আইনের শাসন নেই বলেও দেশ-বিদেশে যে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, তার হাতও এতে শক্তিশালী হবে। তাই পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কোনো অসত্য ভাষণ বা উসকানিমূলক উক্তিকে অসিলা করে এমন কোনো কাজ করা বা তাকে সমর্থন করা চলবে না, যাতে আইনের শাসন প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ইতিমধ্যে যা ঘটানো হয়েছে, সেই সব ঘটনাকে আইনের আওতায় এনে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে বিচার করতে হবে।’
‘৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারির ঘটনার দায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের ওপরেই অনেকাংশে বর্তায়। সরকারের পক্ষ থেকে ঘটনা–পরবর্তী একটি বিবৃতি দিয়ে এ দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। যেকোনো দেশের ঐতিহাসিক নিদর্শন, স্থান কিংবা কোনো স্থাপনা সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব সেই দেশের রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের। ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান, বাড়ি বা অন্য কোনো স্থাপনা—ওই স্থানে কারা কোন সময় বসবাস করেছেন বা কাদের নাম জড়িত, সেই নিরিখে বিচার্য নয়। মূল্যায়ন যে যেভাবেই করুক, তার ওপরে তার সুরক্ষার প্রশ্নটি নির্ভর করে না। এটা সভ্য সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।’
‘পৃথিবীর সব দেশেই এভাবে ঐতিহাসিক স্থান ও কীর্তিগুলো যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে সুরক্ষা করা হয়। অনেক নির্মম নির্দয় শাসকের বাসভবনও দর্শকেরা তা–ই দেখতে পান, তাদের কীর্তি-অপকীর্তি সম্পর্কেও বহু শত বছর পরও মানুষ জানতে পারেন। আমরা তাই ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারির ঘটনার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সবিস্তার ব্যাখ্যা দাবি করছি এবং এর সুষ্ঠু বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও এর জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবহেলাসহ যারা দায়ী, তাদের জবাবদিহি ও শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।’
‘৩২ নম্বর ধানমন্ডির ঐতিহাসিক বাড়ি ভাঙার সঙ্গে স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের শক্তি প্রদর্শনের কোনোই সম্পর্ক নেই; বরং এটা একধরনের গণ–উত্তেজক সন্ত্রাসের প্রদর্শন বলেই জনগণের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। যা ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ভাবমূর্তিকেই ম্লান করে দেয়। এটা আমাদের গভীর উদ্বেগের বিষয় যে তারুণ্য আমাদের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের মূলশক্তি হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি, সেই তরুণদের একাংশকে কোনো দেশি বা বিদেশি অপশক্তি বিপথে পরিচালিত করতে নেপথ্যে সক্রিয় রয়েছে কি না, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেটিও আজ খতিয়ে দেখা খুবই জরুরি।’
বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন সুলতানা কামাল, রাশেদা কে চৌধূরী, আনু মুহাম্মদ, খুশী কবির, পারভীন হাসান, ইফতেখারুজ্জামান, শামসুল হুদা, সারা হোসেন, সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, সুব্রত চৌধুরী, নুর খান, শাহনাজ হুদা, নোভা আহমেদ, জোবাইদা নাসরীন, মোহম্মদ সেলিম হোসেন, শাহ-ই-মবিন জিন্নাহ, জাকির হোসেন, রেজাউল করিম চৌধুরী, মনীন্দ্র কুমার নাথ, সাঈদ আহমেদ, মিনহাজুল হক চৌধুরী, আশরাফ আলী, শাহাদত আলম, রেজাউল হক, হানা শামস আহমেদ এবং মুক্তাশ্রী চাকমা।