দেশে সহিংসতার শিকার ৫৭ শতাংশ নারীই রাজশাহীর

  • ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, রাজশাহী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে রাজশাহীতে নারীর প্রতি সহিংসতা। গত কয়েক বছর ধরেই এ প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে, আর সর্বশেষ এক বছরে এটি তিন গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপরাধ প্রতিরোধে ব্যর্থতা এবং সার্বিক অস্থিতিশীলতার অনুভূতি নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বাড়িয়ে তুলছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ৫২৩ জন নারী গৃহস্থালি সহিংসতার শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে ২৯৯ জনই রাজশাহীর। এটি দেশের মোট সংখ্যার প্রায় ৫৭ শতাংশ।

বিজ্ঞাপন

প্রতিবেদনটি জাতীয় দৈনিক, অনলাইন মিডিয়া এবং কমিউনিটি সোশ্যাল অর্গানাইজেশনের ১৮০ সদস্যের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ‘অগ্নি’ প্রকল্পের অধীনে তৈরি করা হয়েছে। ব্র্যাকের সহযোগিতায় এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের তহবিলে পরিচালিত এই প্রকল্পটি রাজশাহী ও গাজীপুর জেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে।

বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৩ সালে রাজশাহীতে গৃহস্থালি সহিংসতার শিকার হয়েছিলেন ৯৭ জন নারী, যা ২০২৪ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯৯ জনে। এদের মধ্যে ১০ জন আত্মহত্যা করেছেন এবং ১৮ জন স্বামী বা স্বামীর পরিবারের সদস্যদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন। ২০২৩ সালে আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল মাত্র ১টি এবং হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল ৭টি।

বিজ্ঞাপন

২০২৪ সালে ২৫৫ জন নারী যৌতুকের কারণে নির্যাতিত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৮ জন নিহত এবং ২ জন আত্মহত্যা করেছেন। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৯০ জন, যেখানে ৫ জন নিহত হয়েছিলেন। অর্থাৎ, ২০২৪ সালে ২০২৩ সালের তুলনায় ৬৫ জন বেশি নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

জেলায় নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির ঘটনাও দ্বিগুণ বেড়েছে। ২০২৪ সালে ৫৪ জন নারী ও শিশু যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন, যাদের মধ্যে ১ জন প্রতিবাদ করায় নিহত হয়েছেন এবং ৩২ জন শারীরিকভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ২৭ জন।

এছাড়া, ২০২৪ সালে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে ২৮টিতে দাঁড়িয়েছে, যা ২০২৩ সালে ছিল ২৫টি।

রাজশাহীতে নারীদের ও শিশুদের বিরুদ্ধে গৃহস্থালি সহিংসতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০২৩ সালে যেখানে ৩৭টি মামলা হয়েছিল, ২০২৪ সালে তা বেড়ে ৬৬টিতে পৌঁছেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, চলমান মূল্যস্ফীতি এবং অপরাধীদের শাস্তির অভাবের সংস্কৃতির কারণে এই প্রবণতা বাড়ছে।

রাজশাহী আইন ও সালিশ কেন্দ্রের অগ্নি প্রকল্পের জেলা ব্যবস্থাপক হাসিবুল হাসান পাল্লব গৃহস্থালি সহিংসতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক কষ্টকে দায়ী করেছেন।

তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়েছে, কিন্তু সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর মধ্যে উদ্বেগ ও চাপ তৈরি হয়েছে, যা প্রায়ই নারীদের ও শিশুদের ওপর নির্যাতন বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

৫ আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, যারা পূর্ববর্তী রাজনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছিলেন, তারা এখন সমস্যায় পড়েছেন। এর ফলে, তাদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, যা অনেক ক্ষেত্রে গৃহস্থালি সহিংসতার রূপ নিচ্ছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপিকা ওয়ারদাতুল আকমাম পাল্লবের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, মূল্যস্ফীতি, নারীদের গৃহস্থালি নির্যাতন মেনে নেওয়ার প্রবণতা, ৫ আগস্টের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বাড়িয়েছে।

তিনি একটি গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, গৃহস্থালি সহিংসতার শিকার প্রায় ৬০ শতাংশ নারী মনে করেন যে, স্বামীর দ্বারা নির্যাতন অপরাধ নয় বরং এটি স্বামীর অধিকার।

তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্টের গণআন্দোলনের পর রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলো সহিংসতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। যেসব ব্যক্তি রাজনৈতিক সংযোগের মাধ্যমে বৈধ-অবৈধ উপায়ে আয় করতেন, তারা এখন সমস্যায় পড়েছেন, যা অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে।

আকমাম আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপরাধ প্রতিরোধে ব্যর্থ হওয়ায় এবং সমাজে সাধারণ অস্থিরতা বেড়ে যাওয়ায় নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক পুরুষ এখনো মনে করেন, নারীরা দুর্বল এবং তাদের নির্যাতনের জন্য কোনো শাস্তি হবে না।

রাজশাহী মহিলা পরিষদের সভাপতি কল্পনা রায় সহিংসতা বৃদ্ধির জন্য অপরাধীদের শাস্তির অভাবকে দায়ী করেছেন।

তিনি বলেন, নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বাড়ছে কারণ বর্তমান অপারাধমুক্ত সংস্কৃতি অপরাধীদের শাস্তি এড়াতে সহায়তা করছে। এটি নির্যাতনকে স্বাভাবিক করে তুলছে, ভুক্তভোগীদের ভয় দেখিয়ে নীরব করছে এবং বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা নষ্ট করছে।

তিনি আরও বলেন, সরকারকে নারীদের ও শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনায় দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে এবং বিশেষ করে গ্রামীণ নারীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে।