গ্রামে নেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পাঠাগারেই আলো ছড়াচ্ছে ২০ বছর

  • ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঝিনাইদহ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

গ্রামে নেই কোনো স্কুল, কলেজ বা মাদ্রাসা, নেই খেলার মাঠও। গ্রাম থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুরত্ব প্রায় ৭ কিলোমিটার। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকলেও গ্রামটিতে রয়েছে একটি পাঠাগার। অবসর সময়ে শিক্ষার্থীরা এই পাঠাগারে বই পড়েই সময় কাটায়। কেউ কেউ আবার বই বাড়িতেও নিয়ে যায়। এতে দিতে হয়না কোনো ফি। শুধুমাত্র খাতায় এন্ট্রি করলেই পাওয়া যায় বই।

গত বিশ বছর ধরে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা গ্রামে ‘বিএসডি ক্লাব এন্ড পাঠাগার’ বিশ বছর ধরে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

জানা যায়, শৈলকুপা উপজেলা শহর থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের দক্ষিণ পাড়ায় স্কুল পড়ুয়া তরুণেরা ২০০৪ সালে নিজেদের উদ্যোগে পাড়ার পরিত্যাক্ত একটি জায়গায় একটি টিনের ঘর করে তাতে চাটাইয়ের বেড়া দিয়ে সাইনবোর্ড লাগিয়ে নামকরণ করেন ‘বিএসডি ক্লাব’। কয়েকবছর পর ক্লাবটিকে ‘বিএসডি ক্লাব এন্ড পাঠাগার’ নামে নতুনভাবে নামকরণ করা হয়। সংগ্রহ করা হয় বইয়ের তাক, চেয়ার টেবিল ও বই। প্রাথমিকভাবে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আলমগীর অরণ্যের সংগ্রহ থেকে তিন শতাধিক বই নিয়ে শুরু হয় পাঠাগারের কার্যক্রম। পরে অন্যদের সংগ্রহে থাকা আরও দুই শতাধিক বই নিয়ে গড়ে তোলা হয় পাঠাগারটি। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে বেসরকারি গ্রন্থাগার উন্নয়ন প্রকল্পের অধিনে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় পাঠাগারটিকে এক লক্ষ বিশ হাজার টাকা অনুদান বরাদ্দ দেয়। সরকারি রেজিস্ট্রেশন পেয়ে সরকারি ওই অর্থ সংগ্রহ করে পাঠাগারে শুরু হয় নবউদ্যোমে কর্মকাণ্ড। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ৫০% টাকা খরচ করে নতুন ঘর নির্মাণ করা হয়। বাকি টাকায় ঢাকা থেকে নতুন বই কেনা হয়। শুরু হয় নতুন করে পথচলা।

পাঠাগারটির পরিচালনা কমিটির সদস্য আলমগীর হোসেনের ভাষ্যমতে, বর্তমানে এ গ্রন্থাগারের সংগ্রহে রয়েছে দুই হাজারের অধিক বই। মোট বইয়ের ৫০ শতাংশই উপন্যাস, গবেষণাগ্রন্থ আছে ২০ শতাংশ, বাংলাদেশ ও বিশ্বের ইতিহাস ও ঐতিহ্যভিত্তিক বই আছে ১০ শতাংশ এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই আছে ১০ শতাংশ। বই ছাড়াও পাঠকদের চাহিদা পূরণ করতে প্রতিদিন ৩টি জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিক পত্রিকা এবং ২টি সাময়িকী নিয়মিত রাখা হয়। এছাড়া প্রকৌশলী ড. গোলাম মোস্তফার নামে একটি শিক্ষাবৃত্তি প্রকল্প চালু আছে। পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে প্রতি বছর ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত ১৫ জনকে দেওয়া হয় শিক্ষাবৃত্তি। এ উপলক্ষে বছরে তিনটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বইপড়া কর্মসূচিতে প্রতিবছর সেরা পাঠককে দেওয়া হয় পুরস্কার।

বিজ্ঞাপন

সরেজমিনে ওই পাঠাগারটিতে গিয়ে দেখা যায়, উপন্যাস, কবিতা, গল্প, মুক্তিযুদ্ধ, গবেষণা, ইতিহাস, ঐতিহ্যের বইয়ে ভরা রয়েছে সাতটি আলমারি। মাঝখানে বসানো দুটি লম্বা টেবিল, একটি গোলটেবিল, টিনের বেড়ার সাথে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্তের ছবি, বীরশ্রেষ্ঠদের ছবিও আছে। সারি করে রাখা চেয়ারে বসে আছেন কয়েকজন পাঠক। কেউ বই পড়ছেন, কেউ দৈনিক সংবাদপত্র, কেউবা সাময়িকী। তবে সময়ের সাথে সাথে পাঠাগারের ঘরটির অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে। দরজা-জানালা ভেঙে গেছে, টিনের ছাদ ভেঙে সূর্যের আলো উঁকি দিচ্ছে। বর্ষায় বইয়ের সংরক্ষণ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে চিন্তা দেখা দিয়েছে।

আবু আরিফ রেজা নামের এক পাঠক বলেন, ‘আমি নিয়মিত পাঠাগারে এসে বই পড়ি। এখানে বই পড়তে কোনো রেজিস্ট্রেশন করা লাগেনা, বই বাড়িতে নিয়ে গেলেও আমাদের কাছ থেকে কোনো টাকা নেওয়া হয়না। এছাড়া আমরা যে বইগুলো অন্য কোথাও পাইনা তা এই ক্লাবে পেয়ে থাকি। তারা আমাদেরকে বই পড়ার জন্যই উদ্বুদ্ধ করছে। আমরা চাই সরকারি সহযোগিতায় ক্লাবটির প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হোক।’

মাছুরা আক্তার নামের অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ছেলেদের পাশাপাশি আমরা মেয়েরাও আমাদের গ্রামের এই পাঠাগারের বই নিয়ে বাড়িতে নিয়ে যায়। পড়া শেষে আবার ক্লাবে পৌঁছে দিই।’

পাশ^বর্তী চতুড়া গ্রামের স্কুল শিক্ষক আব্দুস সালাম জানান, ‘প্রয়োজনীয় বই এই পাঠাগারে এসে পেয়ে যাই। তাই যখন যে বই দরকার পড়ে তা নিতে পাঠাগারটিতে চলে আসি। এসে কিছুক্ষণ সময় কাটালাম। সন্তানদের পড়ার জন্য বই বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি আবার এসে পাঠাগারে রেখে যাবো।’

শহিদুজ্জামান বাবু নামের এক পাঠক বলেন, ‘যুবক-যুবতীদের জন্য এটা এমন একটা পাঠাগার যে যারা খারাপ পথে যাবে, তারা এই পাঠাগারে সময় কাটালে খারাপ কাজগুলো থেকে বিরত থাকবে। আমরা দেখেছি এখানে সবসময় উঠতি যুবকদের পদচারণা থাকে। তারা নিয়মিত পাঠাগারে এসে বই পড়ে সময় কাটায়।’

পাঠাগারটির পরিচালনা কমিটির সদস্য আলমগীর হোসেন জানান, ‘নির্দিষ্ট জায়গায় ক্লাব খোলার চাবি রাখা হয়। সকাল-বিকাল যে যখন আসে চাবি নিয়ে পাঠাগার খুলে বই পড়ে। এছাড়া কেউ আসলে আমরা পাঠাগার খুলে দিই। পাঠকের পছন্দের কোনো বই থাকলে তারা নিজে বেছে নেয় এবং আমাদের জানালে আমরা তাদের বই খুঁজতে সহায়তা করি।’

বিএসডি ক্লাব এন্ড পাঠাগারে সভাপতি আলমগীর অরণ্য বলেন, ‘দীর্ঘ প্রায় ১২ বছর আমি পাঠাগারের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। আমরা মনে করি আমাদের এই পাঠাগারটি এই অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের অনেক সহায়ক হিসেবে কাজ করছে। আমাদের গ্রাম ছাড়াও পাশ^বর্তী কয়েক গ্রামের যুবক-যুবতীরা এখানে বই পড়তে আসে।’ তিনি জানান, ‘পাঠাগারের ঘরটির অবস্থা বর্তমানে খুবই খারাপ। ঘরটি পুননির্মাণ না করা গেলে আগামীতে ঝড়-বৃষ্টিতে পাঠাগারে থাকা সব বই নষ্ট হয়ে যাবে। তাই ঘরটি খুব দ্রুতই মেরামত করা প্রয়োজন। কারণ টিনের ঘরে এই ধরণের পাঠাগার গড়ে তোলা সম্ভব না।’

এই বিষয়ে শৈলকুপা উপজেলা নির্বাহী অফিসার স্নিগ্ধা দাস জানান, ‘উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা এলাকায় বিএসডি ক্লাব নামের পাঠাগারটি ওই এলাকার সচেতন মানুষের জ্ঞান আলোচনা এবং জ্ঞানের প্রসার ঘটানোর ক্ষেত্রে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। পাঠাগারের পক্ষ থেকে যেকোনো প্রয়োজনে সরকারি অনুদান পাওয়ার জন্য লিখিত আবেদন করলে আমরা সহযোগিতা করার চেষ্টা করবো।’