জাতীয় পার্টির হাল হকিকত
জাতীয় পার্টির জেলা ও মহানগর কমিটিগুলোর বেহাল অবস্থা, ৭৫ কমিটির মধ্যে ৫১ কমিটির মেয়াদোত্তীর্ণ। ৯ বছর আগে মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে এমন জেলা কমিটিও এখন বিদ্যমান। আবার এমনও অনেক জেলা রয়েছে যেখানে সম্মেলন হয়েছে কয়েক বছর আগে কিন্তু কমিটি গঠন করা যায় নি।
রোববার (২৭ অক্টোবর) দুপুরে জাতীয় পার্টির বনানী কার্যালয়ে বিভাগীয় সাংগঠনিক টিম সমূহের যৌথসভায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
সবচেয়ে নাজুক অবস্থা রাজধানীর সবচেয়ে নিকটবর্তী জেলা নারায়ণগঞ্জের কমিটির। ২০১২ সালের আগস্টে মেয়াদ শেষ হয়েছে নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির। এরপর আর কোনো খোঁজ নেই এই কমিটির। একই সময়ে শেষ হয়েছে নারায়ণগঞ্জ মহানগর কমিটির মেয়াদও। জাতীয় পার্টির অনেক প্রভাবশালী নেতা রয়েছেন এই জেলায়।
ঢাকার পার্শ্ববর্তী আরেক জেলা গাজীপুরের অবস্থাও নাজুক। এই জেলার আহ্বায়ক কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে। অথচ রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি ও শোডাউনের ক্ষেত্রে এসব জেলার উপর নির্ভরশীল থাকে। স্বল্প সময় ও স্বল্প খরচে লোকজন এনে জমায়েত বাড়ানো সম্ভব হয়। সেই জেলাগুলোর বেহাল অবস্থা জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধীদল জাতীয় পার্টির।
ঢাকা বিভাগের ৪ মহানগর ও ১২ জেলা কমিটির মধ্যে ১১ কমিটির মেয়াদ শেষ। বলা হয় রাজধানীতে যে দলের ভিত যত মজবুত সেই পার্টি রাজনীতির ক্ষেত্রে তত বেশি সুবিধা পেয়ে থাকে। প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একাধিক সভায় বলেছিলেন, শুধু ঢাকায় আন্দোলনের কারণে আমাকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে। কিন্তু সেই ঢাকা বিভাগে জাপার সাংগঠনিক অবস্থা অনেকদিন ধরেই নড়বড়ে।
সবার আগে কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে জাতীয় পার্টি সবচেয়ে ভাগ্যবান কেন্দ্রীয় নেতা মজিবুল হক চন্নুর জেলা কিশোরগঞ্জের। তিনিই সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতার উষ্ণতা ভোগ করেছেন। এখনো করে যাচ্ছেন। চুন্নুর জেলা কিশোরগঞ্জের আহ্বায়ক কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে। ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও কাউন্সিল করা হয়নি। খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে জেলা জাপার কার্যক্রম।
বিভাগ ভিত্তিক বলতে গেলে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা সিলেট বিভাগের। রংপুরের পরে সিলেটকে বলা হয় জাতীয় পার্টির জন্য দ্বিতীয় উর্বর ক্ষেত্র। এখানে জাতীয় পার্টির অনেক রিজার্ভ ভোট রয়েছে। এই বিভাগের প্রার্থীরা প্রত্যেক নির্বাচনেই ভালো ফল পেয়েছেন। এই বিভাগের মহানগর ও ৪ চার জেলা কমিটির সবকটির মেয়াদ শেষ বলা যায়।
২০১৪ সালে শেষ হয়েছে সুনামগঞ্জ জেলার আহ্বায়ক কমিটির মেয়াদ। ২০১৭ সালের ৯০ দিনের সময় দিয়ে গঠন করা হয়েছিলো সিলেট জেলার সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি। সেখানেই আটকে আছে শাহজালালের পুর্নভূমি সিলেট জেলা জাপার কার্যক্রম। মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলা জাতীয় পার্টির সম্মেলন হয়েছে ২০১৮ সালের আগস্টে। এক বছর পেরিয়ে গেলেও কমিটি গঠন করা যায়নি। ঝুলে রয়েছে কমিটি গঠনের কার্যক্রম। কমিটির মতো জাতীয় পার্টির কার্যক্রমও নেতা কেন্দ্রিক আবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
এদিকে জাতীয় পার্টির ঘাটি হিসেবে পরিচিত রংপুর বিভাগের অবস্থাও বেহাল বলা যেতে পারে। পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের ওই নিজ বিভাগের এক মহানগর ও ৮ জেলা কমিটির মধ্যে ৫টির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু কমিটি গঠন করা যায় নি। খোদ চেয়ারম্যানের নির্বাচনী আসন লালমনিরহাট জেলার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে ১৩ মাস আগে। প্রায় কাছাকাছি সময়ে গাইবান্ধা, পঞ্চগড়, দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলা কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। প্রায় ১৬ মাস আগে রংপুর মহানগর কমিটির সম্মেলন হয়েছে। এখনও কমিটি জমা পড়েনি দফতরে।
পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান সংসদীয় দলের নেতা রওশন এরশাদের নির্বাচনী এলাকা ময়মনসিংহ বিভাগেও জাপার অবস্থা ভালো না। এই বিভাগের শুধু নেত্রকোনা জেলা কমিটির মেয়াদ রয়েছে। অন্য তিন জেলার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। সারা দেশে যে বিভাগীয় সাংগঠনিক টিম গঠন করা হয়েছে এই বিভাগের কার্যক্রম নিয়েও সন্তুষ্ট হতে পারছেন নেতাকর্মীরা। কথিত রয়েছে শীর্ষ নেতা রওশন এরশাদের বিরাগভাজন হওয়ার ভয়েই অনেকটা হাত গুটিয়ে বসে রয়েছে সাংগঠনিক টিমও।
রাজশাহী বিভাগের ৮ জেলা কমিটির মধ্যে ৬ জেলার মেয়াদ শেষ। ২০১৬ সালে বগুড়া জেলা কমিটির সম্মেলন হয়েছে তবে এখনো কমিটি গঠন হয়নি। কেন্দ্রেও কমিটি জমা হয় নি। মুখে মুখে যাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তিনি সেই দায়িত্বে পরিচয় দিচ্ছেন। কিন্তু কেউ দেখেনি কমিটির কাগজ। এরশাদ বেঁচে থাকা অবস্থায় এ বিষয়ে অনেক অভিযোগ উঠেছিল, কিন্তু কোনো সুরাহা হয় নি। বিভাগের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট ও নাটোর কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে।
খুলনা বিভাগের মহানগর ও ৪ জেলা কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। বরিশাল বিভাগের ৬ জেলা ও এক মহানগর কমিটির মধ্যে শুধুমাত্র বরগুনা ও পিরোজপুর জেলা কমিটির মেয়াদ রয়েছে। ২০১৭ সালেই গত হয়েছে অনেক কমিটির মেয়াদ।
চট্টগ্রাম বিভাগের জাপার অবস্থাও খারাপ। এই বিভাগের মধ্যে ১১ জেলার মধ্যে ৮ জেলা কমিটির মেয়াদ শেষ। কুমিল্লা মহানগর কমিটি গঠনেই করা হয় নি। পাঁচ বছর আগে ২০১৪ সালে মেয়াদ শেষ হয়েছে লক্ষ্মীপুর জেলা কমিটির মেয়াদ। অথচ এই বিভাগের নেতা জিয়াউদ্দিন আহমদ বাবলু তখন ছিলেন পার্টির মহাসচিবের দায়িত্বে।
এদিকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেছেন, আমরা বিভাগীয় সাংগঠনিক টিম গঠন করে দিয়েছি তারা এ বিষয়গুলো দেখছেন। রংপুর ও ময়মনসিংহ কমিটি ছাড়া অন্যদের কাজের অগ্রগতি বেশ ভালো দেখলাম।
৩০ নভেম্বরের মধ্যে সবাইকে কমিটিগুলো আপডেট করতে বলা হয়েছে। যে সব জেলায় সম্মেলন করা সম্ভব হবে না, সে সব জেলায় আহ্বায়ক কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান জিএম কাদের।