কয়লা প্রকল্প বন্ধের দাবিতে গণসমাবেশ-পদযাত্রা
কয়লা প্রকল্প বাংলাদেশের পরিবেশ ও অর্থনীতি ধ্বংস করবে উল্লেখ করে কয়লা ব্যবহার বন্ধ এবং সৌরশক্তি ব্যবহারের দাবিতে গণসমাবেশ ও পদযাত্রা কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়েছে।
শুক্রবার (১ নভেম্বর) রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে এ কর্মসূচির আয়োজন করে সামাজিক ও পরিবেশবাদী গণসংগঠন সমূহের সমন্বয়ে গঠিত ঐক্যজোট ‘দক্ষিণ এশীয় জলবায়ু সংকট নিরসনে গণকর্মসূচি (সাপাক)’।
বাপা’র সাধারণ সম্পাদক ও সাপাক-এর আঞ্চলিক সমন্বয় কমিটির সদস্য ডা. মো. আব্দুল মতিনের সভাপতিত্বে এবং বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সচিব ও বাপা’র নির্বাহী সদস্য মিহির বিশ্বাসের সঞ্চালনায় গণসমাবেশে বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান (উপদেষ্টা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স), অধ্যাপক ডা. এম আবু সাঈদ (সভাপতি ডক্টরস ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট), রুহিন হোসেন প্রিন্স (তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য), মাহবুব আলম (ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সহ-সভাপতি), মো. জাহিদ হোসেন (বাংলাদেশ কৃষক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক), লুনা নূর (নারী নেত্রী), খান আসাদুজ্জামান মাসুম (সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন), শরীফ জামিল (সমন্বয়ক ওয়াটারকিপারস বাংলাদেশ), হাসান ইউসুফ খান (সমন্বয়ক নদী পক্ষ), ইবনুল সাঈদ রানা (প্রধান নির্বাহী, নিরাপদ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন), হাফিজুর রহমান ময়না (সভাপতি,নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম), মোহাম্মদ এজাজ (পরিচালক, রিভারাইন পিপলস), সামস সুমন (সভাপতি নোঙ্গর), সরদার হীরক রাজা (লালন গবেষক), আব্দুস সাত্তার (সমন্বয়কারী গ্রিনভয়েস ঢাকা মহানগর) এবং মো. সেলিম (সম্পাদক পবা)।
গণসমাবেশে জোটের অন্যান্য প্রতিনিধিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, মোহাম্মদ আলী (তুরাগ নদী রক্ষা আন্দোলন), মাহবুব হোসেন (নদী কর্মী), মাসুম বিল্লাহ (ডব্লিউবিবি ট্রাস্ট), শাকিল রহমান (ঢাকা যুব ফাউন্ডেশন), আমির হোসেন, জহুরুল ইসলাম (পরিবেশ রক্ষা এখনি) শেখ আসাদ প্রমূখ।
অনুষ্ঠানের সভাপতি ডা. মো. আব্দুল মতিন তার লিখিত বক্তব্যে বলেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণে ২০৫০ সালের মধ্যেই বাংলাদেশের চার কোটি মানুষ সমুদ্রের নোনা পানির ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে। আর এই শতাব্দী শেষে ক্ষতির শিকার মানুষের সংখ্যা সাত কোটিতে পৌঁছাবে। গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যানেল আইপিসিসি থেকে বিশ্বের সমুদ্র নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। তাতে আশঙ্কার চেয়ে দ্রুত হারে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে বলে উল্লেখ করা হয় এবং তাতে এই উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ বিপদে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। দেশের উপকূলের বেশির ভাগ এলাকায় বেড়িবাঁধ রয়েছে। ওই বাঁধগুলোর গড় উচ্চতা ১২ থেকে ১৫ ফুট । কিন্ত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার প্রভাব মোকাবিলায় এসব বাঁধ যথেষ্ঠ উঁচু নয়।
তিনি বলেন, এতদিন ধারণা ছিল এই শতাব্দীর মধ্যে, অর্থাৎ ২১০০ সালের মধ্যে বিশ্বের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দুই মিটার বাড়বে। নতুন তথ্য বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যেই একই পরিমাণ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে। এত দিন ধারণা ছিল, বিশ্বের ২৫ কোটি মানুষ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণে বিপদে পড়বে, এখন মনে হচ্ছে এর সংখ্যা ৬৪ কোটিতে দাঁড়াবে।
লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, বৈশ্বিক গ্যাস নিঃসরণ ও জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের ভূমিকা অত্যন্ত নগণ্য (০.৩%); তা স্বত্তেও বাংলাদেশকেই এর অন্যতম সর্বোচ্চ ক্ষতির স্বীকার হতে হবে। বিজ্ঞানে বলা হচ্ছে - গত তিন বছরের যে অতিরিক্ত গরমের তাপ আমরা খোদ ঢাকা মহানগরীতে ও সারা বিশ্বে ভোগ করছি, তা বিগত ১২ বছর আগে নির্গত গ্যাসের কারণে হচ্ছে। তারপর পার হয়েছি একযুগ। আর আজ থেকে আরো ১২ বছর পর নির্গত গ্যাসের পরিমাণ এতই ক্ষতিকর হবে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব আর নিয়ন্ত্রণযোগ্য থাকবে না, বিশ্বের সার্বিক মারাত্ম ক জলবায়ু দুর্যোগ হবে অপরিবর্তনীয়; মানুষ সহ সকল জীব-গাছপালা হবে মৃত্যুমুখী। ২১০০ সালে নয়, আমাদের মহাদুর্যোগ স্থায়ী হয়ে বসবে ২০৫০ সাল থেকেই। বাংলাদেশের প্রায় ৩০ শতাংশ ভূমি পানির তলায় নিমজ্জিত হবে, দক্ষিণাঞ্চল থেকে উৎখাত হবে ৫-৭ কোটি মানুষ। ধ্বংস হবে আমাদের পরিবেশ, প্রকৃতি, ফসল ও সকল সম্পদ।
আব্দুল মতিন আরও বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন কয়লা বা জীবাশ্ম জ্বালানি নয়, সৌর ও অন্যান্য বিকল্প জ্বালানি থেকে করতে হবে। পশ্চিমা বিশ্ব জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করেছে বলে আমাদেরও তাই করতে হবে, এই ধারণাটি সঠিক নয়। এখন আর যেনতেন প্রকারে উন্নয়ন করার সুযোগ নেই; শুধুমাত্র জাতিসঙ্ঘ নির্দেশিত টেকসই প্রক্রিয়ায়ই তা করতে হবে। আমরা কারো কয়লা ডাম্পিং করতে পারি না। কারণ কয়লা একটি নোংরা জ্বালানি, আর ‘ভালো কয়লা’ একটি নির্জলা মিথ্যা কথা।
অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান বলেন, আমরা পরিবেশের জন্য কাজ করে সরকারকে দেখিয়ে দিতে চাই আমরা ব্যক্তি ও ক্ষুদ্র সাংগঠনের পর্যায় থেকেও পরিবেশ রক্ষা করতে পারি। আমরা প্রতি বছর গাছ লাগিয়ে পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারি। সবাইকে সম্মিলিতভাবে সরকারকে চাপ দিয়ে পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে।
অধ্যাপক এম আবু সাঈদ বলেন, দেশের ও পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন প্রকল্প থেকে সরে আসতে হবে। যেখানে সারা বিশ্ব কয়লা ভিত্তিক প্রকল্প বন্ধ করে দিচ্ছে সেখানে আমাদের সরকার কার স্বার্থে এ মরণ ফাঁদে পা দিচ্ছে তা জাতি জানতে চায়।
শরীফ জামিল বলেন, সরকার রামপাল তাপবিদ্যুৎ পকল্প চালুর মধ্য দিয়ে সুন্দরবনকে ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে। আমরা চাই সরকার এ পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড থেকে ফিরে আসবে দেশ, জাতি ও পরিবেশের স্বার্থে।
মিহির বিশ্বাস বলেন, সারা বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশ আজ ধ্বংসের দোরগোড়াই উপনীত। এখনি সচেতন না হলে দেশের উপকূলীয় এলাকার ধংস অনিবার্য, তাই সবাই সচেতন হয়ে পরিবেশ রক্ষায় কাজ করতে হবে।
রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, দেশের সরকার আজ পরিবেশের ব্যাপারে চরম উদাসীন। তাই আমরা যারা সাধারণ মানুষ আছি যাদের বিদেশে সেকেন্ড হোম নাই তাদেরকেই পরিবেশ রক্ষায় একত্রে কাজ করতে হবে। আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় সরকারকে বাধ্য করতে হবে পরিবেশের পক্ষে কাজ করতে।
হাসান ইউসুফ খান বলেন, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত মারাত্মক সংকটের সম্মুখীন। কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত কার্বন এ সংকটকে আরো ঘনীভূত করছে। এতে বিলীন হয়ে যাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল, তাই এখনি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করতে হবে।
সাপাক আয়োজিত গণসমাবেশে উত্থাপিত দাবিসমূহ—
১) কয়লা প্রকল্প বাংলাদেশের পরিবেশ ও অর্থনীতি ধ্বংস করবে; কয়লা ব্যবহার বন্ধ কর, সৌর শক্তি স্থাপন কর, এসডিজি বাস্তবায়ন কর।
২) সারা বিশ্বে গ্যাস নিঃসরণ বন্ধ কর, ভোগবাদী জীবন পরিহার কর।
৩) উন্নয়নের সকল ক্ষেত্রে ন্যায় পরায়ণতা নিশ্চিত কর।
৪) বিকেন্দ্রিভূত, গণতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ সুশাসন নিশ্চিত কর
৫) বাতাস, পানি-জলাশয়-নদী ও ভূমি তথা পরিবেশ পুনরুদ্ধার কর।
৬) বৃহৎ দূষণকারীদের থেকে সম্পদহানি ও ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ আদায় কর।
‘সাপাক’ জোটের অন্তর্ভুক্ত সংগঠনগুলো হলো—বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা); তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি, সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি, উত্তম দেব নিরাপদ সড়ক প্রচার অভিযান, ডব্লিউবিবি ট্রাস্ট, ডক্টরস ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট, বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলন, ওয়াটারকিপারস বাংলাদেশ, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ-স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি, নিরাপদ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন, নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম, ওয়ার্ক ফর গ্রিন বাংলাদেশ, প্রভাতী সমাজ উন্নয়ন সংস্থা, তরুপল্লব, সিডিপি, পুরাতন ঢাকা পরিবেশ উন্নয়ন ফোরাম, আদি ঢাকাবাসী ফোরাম, ঢাকা যুব ফাউন্ডেশন, পুরাণ ঢাকা নাগরিক উদ্যোগ, রিভারাইন পিপলস, পিপলস সার্ক ওয়াটার ফোরাম, বাংলাদেশ ঘুড়ি ফেডারেশন, বড়াল রক্ষা আন্দোলন, নোঙ্গর, উদয়ন বাংলাদেশ, তুরাগ নদী রক্ষা আন্দোলন, নদী পক্ষ ও গ্রিনভয়েসসহ প্রায় ৪০টি সামাজিক ও পরিবেশবাদী গণসংগঠন।