বেগম রোকেয়ার কবরে ফুল দেওয়া হবে না আজও
আজ ৯ ডিসেম্বর সোমবার বেগম রোকেয়া দিবস। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ১৩৯ তম জন্ম ও ৮৭ তম মৃত্যু দিবস আজ। দিবসটি নিয়ে নানা আয়োজন থাকলেও রোকেয়ার জন্মস্থানে এই নারীর অনুরাগীদের মন ভালো নেই। এবছরও রোকেয়ার কবরে ফুল দেওয়ার স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে না। নিরাশার আরও একটি বছর পার হচ্ছে আজ।
বেগম রোকেয়া উপ-মহাদেশের নারী সমাজকে কু-সংস্কারের দেয়াল ছেদ করেছিল। গৃহবন্দী নারীদের হাতে তুলে দিয়েছিল আলোর মশাল। সেই মহিয়সী নারীর স্মৃতিবিজড়িত জন্মস্থান আজও অন্ধকারে। অবহেলা আর উদ্যোগহীনতার কারণে এখানে রোকেয়া চর্চা ও পর্যটন কেন্দ্রের দ্বার রুদ্ধ।
নয় বছর আগে রংপুর জেলা প্রশাসকের দেওয়া রোকেয়ার দেহাবশেষ কলকাতা থেকে পায়রাবন্দে আনার প্রতিশ্রুতিও এখনো লাল ফিতায় বন্দীই রয়ে গেছে। এনিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে নেই কোন জোরালো উদ্যোগ। এখন জেলা প্রশাসনের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ।
মরদেহ আনার ঘোষণা ও কালক্ষেপণ
বর্তমান সরকারের আমলে পাকিস্তান থেকে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের মরদেহ চাঁপাইনবাবগঞ্জে আনার পর রংপুর অঞ্চলের মানুষ রোকেয়ার মরদেহটিও পায়রাবন্দে এনে সমাহিত করার জোরালো দাবি তুলেছিল।
২০০৯ সালের ৯ ডিসেম্বর রোকেয়া মেলায় রংপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক বিএম এনামুল হক দাবিটির প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে উদ্যোগ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। ২০১০ সালে একই স্থানে বিএম এনামুল হক বলেছিলেন, ‘মরদেহ পায়রাবন্দে আনার ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দফতরে আবেদন করা হয়েছে। আগামী বছর (২০১১) রোকেয়া দিবসের আগে তার মরদেহ পায়রাবন্দে আসবে।’
তার এ ঘোষণায় সেইদিন পায়রাবন্দবাসী আনন্দিত হয়েছিল। কিন্তু তার সেই ঘোষণার নয় বছর পূর্ণ হলো আজ। কিন্তু এ ব্যাপারে আর কোন উদ্যোগ নেয়নি জেলা প্রশাসন। আসেনি রোকেয়ার দেহাবশেষ। অথচ বিগত দিনে প্রতিশ্রুত ঘোষণার বাস্তবায়ন দাবিতে বিভিন্ন নারী সংগঠন সভা, সিম্পোজিয়াম, গোলটেবিল বৈঠকসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। রোকেয়া অনুরাগীরা দাবিটি সরকারের উর্ধতন মহলেও জানিয়েছেন।
পায়রাবন্দের মানুষের আক্ষেপ
নীতিনির্ধারক মহলে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না বলে অভিযোগ করে পায়রাবন্দে বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল। তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী বিবিসি’র জরিপে বিশ্বসেরা ২০ নারীর তালিকায় ৬ নম্বর স্থান বেগম রোকেয়ার। অথচ সেই নারীর দেহাবশেষ প্রতিবেশি দেশ থেকে ফিরিয়ে আনতে বছরের পর বছর গুনতে হচ্ছে। এটা দুঃখজনক। পূর্বের ডিসি ঘোষণা দিয়েছিলেন রোকেয়ার কবর পায়রাবন্দে আসবে। কিন্তু সেই ঘোষণা ও সিদ্ধান্ত এখন ফাইলবন্দি।’
অন্যদিকে পায়রাবন্দ বেগম রোকেয়া ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আলিফা ইসরাত মুন্নি বলেন, ‘আমরা যাকে নিয়ে গর্বিত। তার কবর এই মাটিতে হবে। এনিয়ে আমরা আশায় বুক বেঁধে আছি। প্রতিবছর রোকেয়া দিবসে মন চায় মহিয়সী নারীর কবরে শ্রদ্ধা জানাব। কিন্তু সেই আশায় বছরের পর বছর কেটে যাচ্ছে। ডিসির ঘোষণা বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ নেই।’
বেগম রোকেয়ার দেহাবশেষ ফিরিয়ে আনা নিয়ে এমন কালপেক্ষণে ক্ষুদ্ধ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহফুজুল ইসলাম বকুল। আক্ষেপ নিয়ে এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমাদের আবেগ নিয়ে সবাই উপহাস করে। সেইদিন ডিসি সাহেব যে সস্তা হাততালি নেওয়ার জন্য রোকেয়ার দেহাবশেষ আনার ঘোষণা দিয়েছিলেন তা এখন স্পষ্ট।’
এদিকে রোকেয়ার ভাতিজি রনজিনা সাবের বলেন, ‘এখন সরকার চাইলে কিছু হয় না, এটা মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না। আমাদের এই সামান্য দাবিটা সরকার পূরণ করতে পারছে না। অন্যদের মরদেহ যদি আনা যায়। তবে কেন রোকেয়ার মরদেহ আনতে বিলম্ব হচ্ছে। আর কত বছর অপেক্ষা করতে হবে। আর কত টালবাহনা দেখতে হবে। আমরা রোকেয়ার কবরে ফুল দিতে চাই। শ্রদ্ধা জানাতে চাই।’
এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য রংপুরের বর্তমান জেলা প্রশাসক আসিব আহসান এর সঙ্গে একাধিকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায় নি।
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত
বাংলা তথা উপমহাদেশের বন্দী নারীদের শিকল ছিড়ে স্বমহিমায় আলোকিত জীবন গড়ার প্রদীপ জ্বালানিয়া পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত। ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দের নিভৃত পল্লী খোর্দ্দমুরাপুর গ্রামে জন্ম তার। বিখ্যাত সাবের পরিবারের জহির উদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের ঔরসে ও রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮ বছর বয়সে খান বাহাদুর সাখাওয়াত হোসেন সাহেবের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ২৮ বছর বয়সে স্বামী হারান তিনি। ১৯১০ সালের শেষ দিকে কলকাতায় যান তিনি। এরপর তিনি দু’পারেই নারী জাগরণ ও উন্নয়নে কাজ করেছেন।
নারী জাগানিয়া চিন্তা থেকে লিখেছেন অবিরাম-অবিরত। সমাজের কুসংস্কার ভাঙতে করেছেন সময়ের সাহসী উচ্চারণ। তার লেখা অবরোধবাসিনী, সুলতানার স্বপ্ন, পদ্মরাগ, অর্ধাঙ্গী, মতিচুর ছাড়াও অসংখ্য কালজয়ী গ্রন্থ সে সময় নারী জাগরণ আন্দোলনকে উজ্জীবিত করে। আজও তা আন্দোলিত করছে বিশ্ব নারী সভ্যতাকে। মহিয়সী এই নারী ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর কলকাতায় মারা যান। সেখানকার সোদপুরে তাকে সমাহিত করা হয়।