খাওয়ার, কেনাকাটার স্বর্গরাজ্য কলকাতার বড়বাজার
কলকাতার বড়বাজার মানে একটি বাজার নয়, অনেক বাজার। অনেক গলি গায়েগায়ে লাগানো আস্ত এক মার্কেট প্লেস। পূর্ব ভারতের সবচেয়ে বড় সাপ্লাই জোন বড়বাজার হলো পাইকারি ও খুচরা মার্কেটিং-এর স্বর্গ। সঙ্গে আছে হাজার পদের খাবারের অঢেল আয়োজন।
কলকাতার চারদিক থেকে সহজে পৌঁছুতে পারা যায় বড়বাজারে, যার আরেক পোষাকি নাম চীৎপুর। উত্তর-দক্ষিণে প্রসারিত সেন্ট্রাল অভিনিউ ধরে ঐতিহাসিক মোহাম্মদ আলী পার্কে নেমে শুরু করা যায় বড়বাজার যাত্রা। কিংবা পূর্বের শিয়ালদহ থেকে পশ্চিমের হাওড়া সেতুগামী সাবেক হ্যারিসন রোড বা বর্তমান মহাত্মা গান্ধি সড়ক ধরে বড়বাজারের সুবিধাজনক স্থানে পৌঁছানোও সহজ।
চাঁদনিচক, কলুটোলা, গিরিশ পার্ক, শোভা বাজার চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে বড়বাজারকে। পায়েদলে বা টানা রিকসায় অসংখ্য গলির একটি ধরে বড়বাজারের হৃৎপিণ্ডের মধ্যে চলে আসাও সহজ।
বড়বাজারের কেন্দ্রস্থলে বিখ্যাত নাখোদা মসজিদ। জাকারিয়া স্ট্রিটের কিছুটা হয়ে রবীন্দ্র সরণিতে এসে মিশেছে মসজিদের সীমানা। আর চারপাশে গলি-উপগলিতে একেক জিনিসের ভাণ্ডার। কোথাও শাড়ি, কোথাও প্রসাধনী, কোথাও গরম মশলা, কোথাও হাকিমি-কবিরাজি ঔষধ, কোথাও লোহা-লক্কর, কোথাও ছাতা, ঘড়ি, সাইকেল। কি নেই বড়বাজারে! বলা হয়, হাতি থেকে আলপিন, সবই বড়বাজারে মিশে থাকা নানা সরু সড়কের গলি, তস্য-গলিতে পাওয়া যায়।
চেহারাটা খানিকটা পুরনো ঢাকার মতো। ভিড়, শব্দ, দামাদামি চলছে চারপাশে। কমদামে ও দ্রুত সেরা দ্রব্যটি হাসিল করতে কলকাতার নাগরিকরা ছুটে আসেন এখানে। দমদমের পাড়ায় যে চশমার ফ্রেম আড়াই হাজার টাকা আর পাওয়ার বানিয়ে ডেলিভারি দিতে তিন দিন সময় নেয়, বড়বাজারে তা এক তুড়ির ব্যাপার!
নিজের চশমা তৈরি করতে হবে তাড়াতাড়ি, হাতে সময় নেই, পরদিন রওনা দেবো জয়পুর, আজমির হয়ে আগ্রা ও দিল্লি। ছুটে এলাম বড়বাজারে। জানলাম, চশমার ঘাঁটি হলো ক্যানিং স্ট্রিটে। আড়াই হাজারের ফ্রেম দেড় হাজারে রেডি পাওয়ারসহ ডেলিভারি পেলাম দুই ঘণ্টায়।
মাঝের সময়টুকুতে ঘুরে দেখি শুধু কলকাতা নয়, পুরো ভারতের প্রাচীন ও বৃহত্তম বাণিজ্যকেন্দ্র। প্রাচীনের যাবতীয় ছাপ লেগে আছে বড়বাজারের ক্ষয়ে যাওয়া দালানে, ভাঙা দেয়ালের মুখ-বের-করা ইটে।
সেই ঔপনিবেশিক আমলে ভারতের সব সম্প্রদায়ের মানুষ, ধর্ম, বর্ণের লোক এখানে ছুটে এসেছিলেন ভাগ্য ফেরাতে। পর্তুগিজ চার্চের সামনে দাঁড়িয়ে প্রাচীন বণিকদের কথা মনে পড়ে। জৈন টেম্পল দেখে রাজস্থানের যোধপুর-মারওয়ার থেকে আগত মারোয়ারি ঝুনঝুনওয়ালা, আগরওয়ালাদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। আছে গুজরাতি মেহতা ও প্যাটেলদের বিরাট দালান ও কারবার। শিয়া মুসলিমদের ইমামবাড়াও রয়েছে বড়বাজারে নাখোদা মসজিদের খানিক দক্ষিণ-পশ্চিমে। সুন্নি মুসলমানদের একটি প্রাচীন মুসাফিরখানাও দেখেছি শতবর্ষী রয়েল ইন্ডিয়া হোটেলের কয়েক বাড়ি পরে। মুসলিমদের তাবলিগ জামাতের প্রধানকেন্দ্র বড়বাজারের কলুটোলায়। আর হিন্দু মন্দির তো গলিতে গলিতে।
সর্বভারতীয় একটি অবয়ব বড়বাজারে স্পষ্ট। পুরো দেশে আমদানি-রফতানির জন্য সব এলাকার মানুষই এখানে আছেন। আছে তাদের নিজস্ব সমাজ ও ধর্মস্থান। আর আছে সহজ যোগাযোগের জন্য উর্দু ও হিন্দি ভাষার দাপট। বাংলা ভাষাকে বড়বাজারে খুঁজে পেতে কষ্টই হয়। দোকানদার থেকে হোটেল বয়, রিকসাওয়ালা পর্যন্ত উর্দু বা হিন্দিতে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
বাহারি খাওয়া-দাওয়ার জন্য বড়বাজার মশহুর। রমজানে বড়বাজার এশিয়ার সবচেয়ে বিশাল ইফতারি ও মুঘলাই খানার পসরা সাজিয়ে উন্মোচিত হয়। বছরের অন্য সময়েও আর কোথাও পাওয়া যাবে না, এমন খাবার বড়বাজারে সুলভে সহজলভ্য। মাহি আকবরি, কোফতা, গ্লাসি আর মুর্গ চেঙ্গিসি'র নামই শুনেনি অনেকেই, তা মিলবে বড়বাজারে।
ফিয়ার্স লেন, কলুটোলার দিক থেকে জাকারিয়া স্ট্রিট—নাখোদা মসজিদের পাড়ায় পদে পদে অপেক্ষমান অজস্র বিস্ময়। এমনিতে এ পা়ড়ার বাতাসে বছরভরই মিশে থাকে সুখাদ্যের সুরভি। তবে রমজানে এ তল্লাট দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানেই 'ট্রাডিশনাল ফুডওয়াক’, এমনটিই স্বীকার করে তাবৎ কলকাতা। শুধু রোজাদারেরা নন, গোটা কলকাতার খাইয়েরাই আসেন বড়বাজারের স্পেশাল মাছ-মুরগির স্বাদ-স্রষ্টাদের কাছে।
বছরের অন্য সময় দোকানে বা ফুটপাতে লাগাতার লস্যি, ফালুদা, কফি, কাবাব, রুটি, গোস্ত, পরোটা চলছেই। কেনাকাটার বড়বাজারকে কলকাতার খাদ্য-স্বর্গেও পরিণত করেছে এই ঐতিহাসিক এলাকা। মাছ-মুরগির শত পদ জাকারিয়ার স্ট্রিটের গৌরব হয়ে পুরো বড়বাজার পেরিয়ে ছড়িয়ে গেছে সমগ্র কলকাতায়।